বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক অমলিন নক্ষত্র, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম—যাঁর কবিতা, গান ও ভাবনায় রয়েছে মুক্তির আহ্বান, বিদ্রোহের আগুন আর মানবতার অমোঘ জয়গান। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ, খ্রিস্টীয় ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, মঙ্গলবার, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া নামের নিভৃত এক গ্রামে।
এই চুরুলিয়া যেন ছিল কবির ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতীক—উত্তরে অজয় নদী, যাকে পেরোলেই বীরভূম; দক্ষিণে কয়লাখনি আর শিল্পাঞ্চল; পশ্চিমে দামোদর নদী। আর গ্রামের ভেতরেই ছিল রাজা নরোত্তম সিংহের গড় আর পীরপুকুরের পাশের মাটির ঘর—সেখানেই এক প্রভাতবেলায় জন্ম নিয়েছিলেন সেই শিশু, যে একদিন হয়ে উঠবেন নিপীড়িত মানবতার কবি।
নজরুলের জন্মতারিখ নিয়ে পরে কিছু বিতর্ক দেখা দিলেও তাঁর জীবদ্দশায় তিনি নিজেই ১১ই জ্যৈষ্ঠ দিনটিকে জন্মদিন হিসেবে মেনে নিয়েছেন। খ্যাতনামা গবেষক আবদুল কাদিরের রচনায় এবং ‘কৃষক’ পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থে কবি নিজে পাঠ করে অনুমোদন দিয়েছেন এই তথ্য। যদিও সুফী জুলফিকার হায়দারের গ্রন্থে কুষ্টিগণনা সূত্রে ১১ই বৈশাখ উল্লেখ করা হয়, তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
নজরুলের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিহারের পাটনার অধিবাসী। মোগল সম্রাট শাহ-আলমের আমলে তাঁদের পরিবার হাজীপুর থেকে চুরুলিয়ায় চলে আসে। সেই সময় থেকে এই ‘কাজী’ বংশ মোগল আমলের বিচারব্যবস্থার অংশ হিসেবে ‘আয়মা’ সম্পত্তি ভোগ করতেন। কবির জন্ম কেবল একটি ব্যক্তির নয়, বরং একটি বিপ্লবী চেতনার জন্ম।
নজরুলের শৈশব কেটেছে দারিদ্র্য, শোক আর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। তাঁর পিতার অকালমৃত্যু, সংসারের অভাব—সব মিলিয়ে তাঁকে জীবনের প্রথম পর্যায়েই বুঝতে হয় জীবন মানে সংগ্রাম। তিনি কাজ করেছেন লেটো দলে, কখনো রুটির দোকানে, আবার কখনো সৈনিক হিসেবে ব্রিটিশ বাহিনীতে। কিন্তু এই নানা অভিজ্ঞতার মধ্যেই গড়ে উঠেছে তাঁর হৃদয়—যা ছুঁয়ে গেছে পৃথিবীর সকল নিপীড়িত মানুষকে।
তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, নাট্যকার, গল্পকার, সাংবাদিক ও সৈনিক। তাঁর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে এক বিপ্লব ঘটান। তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ ভেঙে মানুষের মুক্তির জয়গান গেয়েছেন—“মসজিদেরই পাশে আমার কাবার ঘর, এক ঈশ্বরে আমি করি বিশ্বাস”—এই সাহসী উচ্চারণই তাঁকে বানিয়েছে সকল ধর্মের মানুষের কবি।
আজ আমরা ২০২৫ সালের মে মাসে এসে দাঁড়িয়েছি কবির ১২৬তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে। তাঁর জন্মদিন শুধু স্মরণ নয়, বরং তা হওয়া উচিত উপলব্ধির দিন—একটি সুযোগ, যখন নতুন প্রজন্মকে তাঁর জীবন, সংগ্রাম, সাহিত্য ও চেতনার সঙ্গে পরিচয় করানো যাবে। এই লক্ষ্যেই 'জাতীয় কবি নজরুল মঞ্চ'-এর উদ্যোগে আমরা গ্রহণ করেছি মাসব্যাপী কর্মসূচি—যার মধ্যে থাকবে আলোচনা সভা, পাঠ প্রতিযোগিতা, নজরুল সংগীতানুষ্ঠান, আবৃত্তি, চিত্রকলা প্রদর্শনী ও গ্রন্থমেলা।
এই আয়োজন আমাদের দায়িত্ববোধেরই বহিঃপ্রকাশ—কারণ আজকের তরুণ সমাজকে যদি নজরুলের পথ চিনিয়ে দেওয়া যায়, তবে তারা শিখবে আত্মমর্যাদা, শিখবে প্রতিবাদ, শিখবে প্রেম আর শিখবে মানুষ হওয়ার পূর্ণতা।
চুরুলিয়ার সেই মাটির ঘরে জন্ম নেওয়া কবি আজও আমাদের মনের মণিকোঠায় বিদ্রোহের আগুন হয়ে জ্বলছেন, প্রেমের মশাল হয়ে আলো দিচ্ছেন। নজরুল আমাদের জাতীয় চেতনার অমূল্য সম্পদ—তাঁকে জানাও কর্তব্য, তাঁকে ভালোবাসাও সাধনা।
চলবে...
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com