সে এসেছে বহু দূর দেশ থেকে—সমুদ্রপাড়ের এক দ্বীপজ দেশ ফিলিপাইন থেকে। সে এসেছে হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে, এক বাঙালি পুরুষের ভালোবাসার মুগ্ধ টানে। শাহিনা—এখন সে আমাদেরই একজন, রক্তে নয়, কিন্তু ভালোবাসায়, ভাষায়, আত্মার গভীর আত্মীয়তায়। আজ থেকে সতেরো বছর আগে সে এসেছিল বাংলাদেশে, এসেছিল চট্টগ্রামে। এসেছিল প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে। সিঙ্গাপুরের চাকরি, নাগরিক জীবন আর পরিচিত সবকিছু ছেড়ে শাহিনা পা রেখেছিল আমাদের এই শ্যামল, সরল, অথচ গভীর আবেগে পূর্ণ মাটিতে। সে যখন প্রথম এই দেশে আসে, তখন সে ছিল বিদেশিনী। কিন্তু আজ? আজ সে একজন বাঙালি মা, একজন ঘরের মানুষ, একজন প্রকৃত ভালোবাসার অনুবাদক। দুটি সন্তানকে কোলে নিয়ে, বাংলার ভাষা বুঝে নিয়ে, মানুষের হাসি-কান্নার সুরে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে শাহিনা আজ এক পরিপূর্ণ জীবনযাপন করে।
পেনিন্সুলা হোটেলে ছয় বছরের চাকরি, ওয়েল পার্কে এক বছর, তারপর রেডিসন ব্লুতে ছয় মাস—চট্টগ্রামের পেশাগত জীবনেও সে তার পদচিহ্ন রেখে গেছে। কিন্তু তার সবচেয়ে চেনা, সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটি শহরের কোনো চাকচিক্যময় দালান নয়। তার সবচেয়ে প্রিয় স্থান চট্টগ্রামের বুকে অবস্থিত সবুজে ঘেরা একটি স্বর্গ—বাটালি হিল।
আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল কোনো আলোকজ্জ্বল প্রেক্ষাগৃহে নয়, কোনো সভা-সমাবেশেও নয়। আমাদের দেখা হয়েছিল সূর্যোদয়ের আলো মেখে ওঠা সেই বাটালি পাহাড়ে, যেখানে প্রতিদিন ভোরে শরীরচর্চার জন্য আসে শহরের কিছু প্রানবন্ত মানুষ। সেই অরণ্যঘেরা মাঠে, বটবৃক্ষের ছায়ায়, বাতাসের হালকা ছোঁয়ায়, পাখির ডাক আর পাতা-ঝরার শব্দে আমাদের পরিচয় হয়েছিল—সহজ, নির্মল আর নির্ভেজাল।
প্রতিদিন ভোরে দেখা হয় তার সঙ্গে। সে আসে সময়মতো, মুখে মিষ্টি হাসি, চলনে আত্মবিশ্বাস। তার আচরণে কোথাও বিদেশি অহংকার নেই, নেই কোন দূরত্বের দেয়াল। বরং সে যেন আমাদের চেনা এক বোন, এক মা, এক প্রাণপ্রিয় বন্ধু। তার পোশাকে শালীনতা, কথায় ভদ্রতা, ব্যবহারে মমতা। সে বাংলায় সাবলীল নয়, কিন্তু বাংলা বোঝে। মাঝে মাঝে ফিলিপিনো টানমিশ্রিত ইংরেজিতে কথা বলে। আর তার সেই অর্ধবাংলা-অর্ধইংরেজি কথার মধ্যে ফুটে ওঠে এক আশ্চর্য আন্তরিকতা, এক ভালোবাসার ভাষা—যা কোনো ভাষায় পূর্ণরূপে অনুবাদ হয় না।
শাহিনা বলে, তার বাবা-মা নেই, ভাইবোনেরা এখনও ফিলিপাইনে। সিঙ্গাপুরে চাকরি করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল এক বাঙালি তরুণের সঙ্গে। সেই পরিচয় গড়িয়েছে প্রেমে, প্রেম গড়িয়েছে জীবনের বাঁকে। সেই বাঁকে পা রেখে সে এসেছে বাংলাদেশে, এসেছে অজানা, অচেনা এক ভূখণ্ডে—কিন্তু এখানে এসে সে খুঁজে পেয়েছে পরিচিতির আলো, আত্মার আশ্রয়।
শাহিনার চোখে বাংলাদেশ এক স্বপ্নপুরী—আলোছায়ায় মোড়ানো, মানুষের হাসিতে ভরা। কিন্তু চট্টগ্রাম তার কাছে আরও গভীর, আরও আত্মিক। সে বলে, “বাংলাদেশের অনেক জায়গায় গিয়েছি, কিন্তু চট্টগ্রামই আমার হৃদয়ের শহর। এই শহরের আলো বাতাস আমার শিরায় শিরায় মিশে গেছে।”
আর এই ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাটালি হিল। সে বলে, “এই পাহাড়ের ছায়া, এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে। আমার দেশের গ্রামে যেখানে আমি ছোটবেলায় দৌড়াতাম, মেঠোপথে হাঁটতাম, সেসব মুহূর্ত বাটালি পাহাড় আমাকে ফিরিয়ে দেয়।”
তার মুখে শোনা যায় একধরনের কৃতজ্ঞতা—চট্টগ্রামের প্রতি, বাংলাদেশের প্রতি, বিশেষ করে বাটালি হিলের প্রতি। সে বলে, “এই পাহাড়ের গাছগুলো আমার বন্ধু, বাতাসটা আমার আত্মীয়, পাখির ডাকে আমার হৃদয় কাঁপে।” এমন করে কেউ ভালোবাসে? হয়তো না। কিন্তু শাহিনা পারে।
সে শুধু একজন মানুষের প্রেমে পড়ে আসেনি এই দেশে, সে এক দেশ, এক সংস্কৃতি, এক প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছে। তার ভালোবাসা আজ শুধু সেই মানুষটির জন্য নয়, এই মাটি, এই নদী, এই পাহাড়, এই বাতাসের প্রতিও সমানভাবে বিস্তৃত। বাটালি হিল তার কাছে একধরনের পবিত্র স্থান—চট্টগ্রামের মানুষের জন্য “নিঃশ্বাসের জায়গা”।
আমরা যারা প্রতিদিন বাটালি হিলে হাঁটতে যাই, আমরা জানি এই পাহাড় শুধু গাছের সারি নয়, এটি আমাদের জীবনের নিরব সঙ্গী, আমাদের শহরের ফুসফুস। আর শাহিনা—একজন বিদেশিনী হয়েও, এই অনুভবকে এমন অন্তর থেকে যেভাবে ধারণ করেছেন, তা আমাদের চমকে দেয়, আমাদের শিখিয়ে দেয় ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ।
সে যেন বলছে, “ভালোবাসা শুধু মানুষের প্রতি নয়, প্রকৃতির প্রতিও হতে পারে। আর সেই ভালোবাসা যদি হয় নিঃস্বার্থ, তবে তা জন্মভূমিকে ছাড়িয়ে আপনভূমিতে রূপ নেয়।”
শাহিনার ভালোবাসা আজ চট্টগ্রামের প্রতিটি ফুলে, পাতায়, বাতাসে ছড়িয়ে আছে। তার প্রতিদিনের হাঁটা, প্রতিদিনের হাসি, প্রতিদিনের কথা—সবকিছু যেন এই পাহাড়ের অরণ্যে গেঁথে গেছে এক-একটি গীতিকবিতার মতো।
বাটালি হিল তার কাছে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, এক জীবন্ত স্মৃতির খাতা, যেখানে প্রতিটি পাতায় লেখা আছে ভালোবাসার গল্প।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com