চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার অন্তর্গত মোহরা কাপ্তাই সড়কের পাশের এক নিরীহ জায়গা—এক সময়ের একটি সেমিপাকা ঘর, এখন পরিত্যক্ত এক কলোনি , যার অন্ধকার অতীত জানলে যে কেউ শিউরে উঠবে। সেই ভবনটি ছিল ওয়াসীম নামে এক ব্যক্তির গড়ে তোলা এক অপরাধ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল, যেখানে ‘প্যাকেজ ব্যবসা’র নামে চলত পতিতাবৃত্তি, চোলাই মদের সরবরাহ, অস্ত্র ভাড়া এবং ডাকাতদের সহযোগিতা।
বাবার দান, ছেলের অপবিত্র ব্যবসা-ওয়াসীমের বাবা আব্দুস চোবান একসময় চট্টগ্রামের একজন সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ২০০৬-০৭ সালের দিকে তার ছেলেকে মোহরা কাপ্তাই সড়কে গোলাপের দোকানের পাশে মাজারসংলগ্ন তিন কাঠা জমি কিনে দেন। সেখানে কিছু সেমিপাকা ঘর তৈরি করে দেন, উদ্দেশ্য ছিল ছেলের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর ওয়াসীম বেকার অবস্থায় পড়ে, এবং সেই ঘরগুলোতে শুরু করে নানা ধরনের কার্যক্রম—প্রথমে ছোটখাটো প্যাকেজ প্রোগ্রামের আড়ালে গানবাজনার দল গঠন, পরে তা ধীরে ধীরে পরিণত হয় পতিতা সরবরাহ, মদের আড্ডা ও অস্ত্র চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে।
প্যাকেজের আড়ালে নারীর দেহ, সন্ধ্যার পর নরকের দরজা-
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর শুরু হতো এই অপরাধচক্রের কর্মব্যস্ততা। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বিয়ের আয়োজনের নামে যেসব নারী শিল্পী আনা হতো, তাদের বড় একটি অংশ আসলে দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্যাকেজ অনুষ্ঠান ছিল শুধুই একটি বাহানা। গান বা নৃত্য ছিল বাইরের মুখোশ, ভেতরে চলতো শরীর বিক্রির নোংরা বাণিজ্য। স্থানীয়দের মুখে মুখে ফিরছে, "ওয়াসীমের ঘরে সন্ধ্যার পর পর নারীরা আসতো, কিন্তু তারা কী করতো, তা বোঝা যেত না—কারণ চারদিকে ছিল গান ও উৎসবের আবরণ।" এই আবরণ ভেদ করে কেউ সহজে প্রবেশ করতে পারতো না, কারণ ওয়াসীম ছিল ভদ্রবেশী, কথাবার্তায় চতুর, এবং ‘পুলিশের সোর্স’ হিসেবে নিজের পরিচয় দিতো।
চোলাই মদের পাইকারি জোগানদার- ওয়াসীমের অন্যতম আদি ব্যবসা ছিল চোলাই মদ। কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা ও রাঙুনিয়া অঞ্চল থেকে নৌ ও সড়কপথে এনে সেই মদ সারা চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহ করত তার নিজস্ব লোকজন। দিনের বেলা নিরবচুপচাপ থাকলেও রাত নামলেই শুরু হতো সরবরাহের মহোৎসব। ছোট ছোট মটরসাইকেল ও রিকশায় করে চলে যেত মদের চালান শহরের অলি-গলিতে।
এ বিষয়ে একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি জানিয়েছেন, মদের গন্ধ বাতাসে থাকলেও কেউ মুখ খুলতো না। ওয়াসীমের ছিল নানা ধরনের পরিচয়—মিডিয়ার লোক, পুলিশের সোর্স, ব্যবসায়ী—এমনকি কখনো কখনো রাজনীতির ছায়ায় থাকার ছদ্মবেশেও নিজেকে উপস্থাপন করতো।
অস্ত্র ভাড়া, ডাকাতদের সহায়তা ও জলদস্যুতা- সবচেয়ে ভয়ানক অভিযোগ হলো, ওয়াসীমের আস্তানায় অস্ত্র মজুদ থাকত, এবং সেগুলো ভাড়া দেওয়া হতো কর্ণফুলী নদী এলাকায় সক্রিয় জলদস্যু ও ডাকাতচক্রের কাছে। এই অস্ত্র ব্যবহার করে তারা নদীপথে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি চালাতো। অস্ত্র ভাড়া দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ পেত ওয়াসীম। একজন সাবেক নারী কর্মী, মীম (ছদ্মনাম), যিনি ২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ওয়াসীমের প্যাকেজ অনুষ্ঠানে কাজ করতেন, জানান—“ওই প্যাকেজ অনুষ্ঠান আর কিসের! সন্ধ্যার পর ওখানে গানগানের নাম করে মেয়েরা আসত, কিন্তু তা ছিল দেহব্যবসার আয়োজন। আর ভিতরে ভিতরে চলতো অস্ত্রের বেচাকেনা, ডাকাতদের সঙ্গে রাতভর যোগাযোগ।”
এখন সাধু সেজে প্রতারণা, কিন্তু অপরাধচক্র থেমে নেই-
বর্তমানে ওয়াসীম নিজের পরিচয় দেয় পুলিশের সোর্স হিসেবে। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে হয়রানি করছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই বলে—“আমি পুলিশের লোক, সাবধানে কথা বলো!” অথচ বাস্তবে সে এখনো তার পুরোনো চোলাই মদের ব্যবসা চালু রেখেছে, রাঙুনিয়া থেকে গরু চুরির চক্রের সঙ্গেও যুক্ত বলে অভিযোগ আছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, এখনো ওয়াসীমের দখলে রয়েছে কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র, যেগুলো বিশেষ বিশেষ সময় নির্দিষ্ট চক্রের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়।
স্থানীয়দের আহ্বান, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি-বোয়ালখালী ও চরণদ্বীপ অঞ্চলের শত শত মানুষ প্রতিবেদকের কাছে বলেছেন, "ওয়াসীমের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত ও আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, এই অপরাধের শিকড় আরও বিস্তৃত হবে।"
চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, এই প্যাকেজ ব্যবসার আড়ালে গড়ে ওঠা অপরাধ সাম্রাজ্য চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যেন এমন ‘সাধু’র মুখোশ খুলে পড়ে।
## বিশেষ ঘোষণা আগামী রবিবার ওয়াসীমেকে নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকায় প্রকাশিত হবে- চোখ রাখুন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com