আজ ২১ এপ্রিল, বিশ্ববরেণ্য কবি, দার্শনিক, রাজনীতিক ও মানবতাবাদী চিন্তাবিদ মুহাম্মদ আল্লামা ইকবালের ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমি একজন লেখক ও কবিভক্ত হিসেবে আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই মহাকবিকে। আমার এই লেখাটি কোনো গবেষণালব্ধ বা বিশ্লেষণাত্মক রচনা নয়, এটি একজন মুগ্ধ পাঠকের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ মাত্র।
শৈশব থেকেই শুনে এসেছি, ইকবাল পাকিস্তানের জাতীয় কবি। ফলে আমাদের মানসে গড়ে ওঠে একটি ভ্রান্ত ধারণা—তিনি বুঝি কেবল পাকিস্তানের কবি। তাই দীর্ঘদিন তাঁকে যথাযথভাবে জানার ও উপলব্ধি করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু লেখালেখির জগতে প্রবেশ করার পর, যখন বিশ্বসাহিত্যের দিকে মনোনিবেশ করলাম, তখন আবিষ্কার করলাম এক বিস্ময়কর সত্য—আল্লামা ইকবাল তো শুধু পাকিস্তানের নয়, তিনি আমাদেরও; তিনি পুরো ভারতবর্ষের কবি।
কারণ, তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর, অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে। আর মৃত্যু হয় ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বহু আগে। অর্থাৎ, তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দুটোই ভারতবর্ষে। পাকিস্তান তখনো মানচিত্রে আসেনি। সুতরাং ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরিখে তিনি ভারতবর্ষের সন্তান, এই মাটি ও মানুষের কবি।
ইকবালের পিতৃপুরুষরা কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ ছিলেন। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কাশ্মীর থেকে শিয়ালকোটে চলে আসেন। তাঁর দাদা শেখ রফিক উদ্দিন ছিলেন শাল ব্যবসায়ী। বাবা শেখ নূর মোহাম্মদ ছিলেন দর্জি, তবে ধর্মপ্রাণ, সুফি ভাবনায় জীবনযাপনকারী একজন মানবিক মানুষ। তাঁর মা ইমাম বিবিও ছিলেন গভীরভাবে ধর্মপরায়ণ, যাঁর প্রভাব পড়েছিল ইকবালের জীবন ও দর্শনে।
আল্লামা ইকবাল ছিলেন এক বহুমাত্রিক প্রতিভা। তিনি কবিতা, ইতিহাস, অধিবিদ্যা, ইসলামি চিন্তাধারা ও রাজনৈতিক ভাবনায় যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিয়েছেন। তাঁর রচিত ফার্সি ও উর্দু কবিতা আধুনিক দক্ষিণ এশীয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ আসরার-ই-খুদি প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে ফার্সি ভাষায়। এরপর একে একে আসে রুমুজ-ই-বেখুদি, পয়গাম-ই-মাশরিক, জাবুর-ই-আজম, বাং-ই-দারা, বাল-ই-জিবরাইল, ও আরমাঘান-ই-হিজাজ—যা এক অনন্য কাব্য-জগৎ রচনা করে।
তিনি ছিলেন দ্বি-জাতি তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা, যার ভিত্তিতে পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন কোনো বিভাজনের কবি নন—তিনি ছিলেন মানবতার কবি। ইকবাল বিশ্বাস করতেন আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে একটি জাতিকে জাগানো সম্ভব। তাঁর “খুদি” দর্শন আত্মার গৌরব, আত্মমর্যাদা এবং নিজস্বতা জাগ্রত করার আহ্বান।
তাঁকে ইরানে ডাকা হয় "ইকবাল-ই-লাহোরী" নামে, যেখানে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি কখনো মৌলভী ছিলেন না, বরং ছিলেন শিক্ষাবিদ—এজন্যই তাঁকে ‘আল্লামা’ উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়। তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ায় ডাকা হয় ‘শায়র-ই-মাশরিক’—প্রাচ্যের কবি নামে। পাকিস্তানে তাঁকে বলা হয় “মুফাক্কির-ই-পাকিস্তান” (চিন্তাবিদ), “মুসাওয়ার-ই-পাকিস্তান” (শিল্পী), এবং “হাকিম-উল-উম্মত” (উম্মাহর পথপ্রদর্শক)।
১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইটহুডে ভূষিত করে। তাঁর বাড়ি শিয়ালকোটে এখনো সংরক্ষিত—যেখানে তাঁর শৈশব কেটেছে, এবং লাহোরের ‘জাভেদ মঞ্জিল’ যেখানে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, সেটি আজ জাদুঘর।
আল্লামা ইকবালের জীবন ও দর্শন আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবায়। একজন কবির কণ্ঠে কীভাবে একটি জাতির আত্মা কথা বলতে পারে, সেটি ইকবালের লেখনী না পড়লে বোঝা যায় না। তিনি কেবল মুসলিম জগতের একজন রত্ন নন, তিনি সমগ্র মানবতার আলোকবর্তিকা। তাই আমি আজ বলতে চাই—আল্লামা ইকবাল ছিলেন ভারতবর্ষের কবি, আমাদের কবি, আমার কবি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com