বকুল মিয়া সারাদিন ফেসবুকে থাকেন। খাওয়ার সময় ফেসবুক, ঘুমানোর সময় ফেসবুক, এমনকি চানাচুর খাওয়ার সময়ও ফেসবুক! তার মতে, "আজকালকার দুনিয়ায় যার ফেসবুক নাই, সে মানুষই না!"
একদিন সকালে বকুল মিয়া ফেসবুকে ঢুকে দেখলেন, এক বিশাল খবর! "কলকাতা থেকে উড়ে আসা বিষাক্ত মাছ খেলে মানুষ তিন দিনে অজগরের মতো ফুলে যায়!" সঙ্গে তিন-চারটা ফটোও দেওয়া, যেখানে কিছু বেচারা মাছ গুটিয়ে পড়ে আছে।
বকুল মিয়া মুহূর্তেই শেয়ার করে দিলেন, সাথে ক্যাপশন— "সতর্ক থাকুন! বাঁচতে চাইলে মাছ থেকে দূরে থাকুন!"
শেয়ার শেষ করেই তিনি ভাবলেন, "এটা তো শুধু আমার জানার দরকার না, পুরো মহল্লাকে জানান উচিত!" তাই মোবাইল হাতে নিয়ে ছুটলেন চায়ের দোকানে।
চায়ের দোকানে বসে থাকা রহিম কাকাকে দেখেই বললেন, "কাকা! জানেন তো? মাছ খেলে এখন মানুষ ফুলে যায়!"
রহিম কাকা থতমত খেয়ে গেলেন, "কী কস বকুল? এইডা আবার কইল কেডা?"
"ফেসবুকে খবর বের হইছে!"
ব্যস, রহিম কাকাও আর দেরি করলেন না। সঙ্গে সঙ্গে দোকানে থাকা সবার চা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "এই মহল্লায় আজ থেকে মাছ নিষিদ্ধ! সবাই সাবধান!"
এক ঘণ্টার মধ্যেই গুজব এমন ছড়িয়ে পড়লো যে, বাজারের মাছওয়ালারা দৌড়ে পালালো!
দুপুর নাগাদ পুরো শহর উত্তাল— "বিষাক্ত মাছ খেয়ে পাশের গ্রামে তিনজন অজগর হয়ে গেছে!"
সন্ধ্যায় বকুল মিয়া যখন আবার ফেসবুকে ঢুকলেন, তখন দেখলেন আসল সত্যি। কেউ একজন পোস্ট করেছে, "সতর্ক থাকুন, কলকাতার বিষাক্ত মাছের খবর সম্পূর্ণ গুজব!" সঙ্গে ছবিগুলোর আসল ব্যাখ্যা— এগুলো আসলে শুকিয়ে যাওয়া মাছ, কোনো বিষাক্ততা নেই!
বকুল মিয়া চমকে উঠলেন, "এই তো সর্বনাশ হইলো! এইডা যদি সবাই জানতে পারে, আমার মান-ইজ্জতই তো শেষ!"
তাই তিনি নতুন একটা পোস্ট দিলেন—
"একটা খবরে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে! আসলে মাছ খাওয়ার কিছু হয়নি, তবে সাবধান থাকা ভালো!"
কিন্তু তখনই তার এক বন্ধু কমেন্ট করলো— "বকুল ভাই, দুপুরে মাছওয়ালাদের তাড়াইলেন, এখন আবার কিছু হয়নি বলেন?"
আরেকজন যোগ করলো— "কাল সকালে মাছের বাজারে যাবেন তো? নাকি শুধু গুজব ছড়াবেন?"
বকুল মিয়া এবার বুঝলেন, ফেসবুক শুধু শেয়ার করার জায়গা না, দায় নেওয়ার জায়গাও!
সেই রাতে তিনি একটি নতুন পোস্ট করলেন—
"গুজবে কান দেবেন না, সত্য যাচাই করুন। নয়তো একদিন নিজেই গুজবের রাজা হয়ে যাবেন!" একটা ছোট্ট খবর, একটু রঙচঙ মাখিয়ে ছড়িয়ে দিলেই মুহূর্তের মধ্যে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে গুজব। সত্য যাচাইয়ের তোয়াক্কা নেই, ভাবনাহীনভাবে শেয়ার করতে পারলেই যেন নিজের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়! অথচ এই গুজব কখনো হাস্যকর ঘটনা তৈরি করে, কখনো ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে।
গুজবের এমনই এক রাজা বকুল মিয়া। তিনি বিশ্বাস করেন, "ফেসবুকই আসল খবরের উৎস।" যে কোনো অজানা তথ্য পেলেই ছড়িয়ে দিতে হবে— কারণ, দেরি করলে অন্য কেউ ‘ব্রেকিং নিউজ’ দিয়ে দেবে! এটাই যেন তার ফেসবুকীয় দায়িত্ব। তাই যখন শুনলেন "কলকাতা থেকে আসা বিষাক্ত মাছ খেলে মানুষ ফুলে যায়," তখন আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। সতর্কতা, শঙ্কা আর ভয় ছড়িয়ে দিতে মুহূর্তেই স্ট্যাটাস দিয়ে দিলেন।
গল্পটা এখানেই থামেনি। তার পোস্ট দেখে পুরো মহল্লায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। বাজারে মাছ কেনাবেচা বন্ধ, কেউ কেউ তো মাছ বিক্রেতাদের ধাওয়া করেও ছেড়েছে! অথচ কয়েক ঘণ্টা পরেই জানা গেল, খবরটি সম্পূর্ণ গুজব!
কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়েই গেছে।
এটাই গুজবের শক্তি। এটি দ্রুত ছড়ায়, কিন্তু সংশোধনের জন্য সময় নেয় বহুগুণ। কারণ, আতঙ্ক সহজে গ্রাস করে, কিন্তু যুক্তি মস্তিষ্কে পৌঁছায় ধীর গতিতে। বকুল মিয়ার মতো অনেকেই আছে, যারা যাচাই না করেই "শেয়ার করলেই দায়িত্ব শেষ" বলে মনে করে। অথচ, একবার ছড়িয়ে পড়া ভুল তথ্য শুধরে দেওয়া যায় না এত সহজে।
গুজবের কারণে শুধু বাজারে মাছ বিক্রি বন্ধ হয় না, সমাজে দাঙ্গা লাগে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি মানুষের প্রাণও চলে যায়! উদাহরণ তো ভুরি ভুরি— একটি মিথ্যা পোস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, চিকিৎসা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, কিংবা হুট করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করা! এসবই প্রমাণ করে, গুজব এক ভয়ংকর ভাইরাস, যা যুক্তিহীন বিশ্বাসকে সংক্রমিত করে।
তাই মনে রাখতে হবে, ফেসবুকের প্রতিটি "শেয়ার" কেবল একটা বাটন নয়, এটা একটা দায়িত্ব। আজকের দিনে সত্য যাচাই না করে কিছু প্রচার করা মানে একটি ভুলের পাহাড় তৈরি করা। যে পাহাড়ের নিচে একদিন নিজেই চাপা পড়ে যেতে পারেন!
তাহলে সমাধান কী?
১. যাচাই করুন: যে কোনো খবর শোনামাত্রই শেয়ার করবেন না। প্রথমে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য যাচাই করুন।
২. বিশ্বাসের আগে প্রশ্ন করুন: খবরটি কোথা থেকে এসেছে? এটি সত্যি নাকি কারও মিথ্যাচার?
৩. গুজব থামানোর দায়িত্ব নিন: যদি ভুল কিছু দেখে ফেলেন, তাহলে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করুন।
৪. সংযমী হোন: ভাইরাল হওয়ার লোভে ভুল তথ্য ছড়ানো বন্ধ করুন।
একটি গুজব হয়তো এক মুহূর্তের মধ্যে ছড়ানো যায়, কিন্তু তার প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে লেগে যায় মাসের পর মাস। বুদ্ধিমান নাগরিক হতে হলে শুধু খবর শুনলেই হবে না, সেটার সত্যতা যাচাই করাটাই সবচেয়ে জরুরি। নয়তো একদিন সবাই বকুল মিয়ার মতো "গুজবের রাজা" হয়ে যাবেন!
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com