এই লেখা আমি আজ লিখতে বসেছি, কিন্তু এখানে আমি একজন সাংবাদিক বা লেখক হিসেবে নয়, বরং একজন সন্তান, একজন উত্তরসূরী হিসেবে লিখছি। এই লেখা, আমার জীবনের প্রতিটি কোণায় লুকানো এক গভীর আবেগের প্রতিফলন। আমি এই লেখাটি লিখছি সেই কবরে, যেখানে আমার বাপদাদার আত্মা শান্তির আশায় শুয়ে আছে, যেখানে তাদের ইতিহাস ও পরম্পরা জড়িয়ে আছে।
আমিও একজন সন্তান, সেই ঐতিহ্যবাহী নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর, যাদের রক্তে বয়ে চলেছে বীরত্ব, আদর্শ ও সংগ্রামের এক অমলিন ধারাবাহিকতা। এই কবরস্থানের পবিত্র মাটি, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের পরিবারে শান্তি ও সম্মানের এক প্রতীক হয়ে রয়েছে, আজ সেই মাটির জন্য এক অসম্মানজনক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি।
আমার মৃত বাবা—যে এখনও আমার হৃদয়ে অদৃশ্যভাবে জীবন্ত—তার আকুতির শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। আমি শুনি তার কণ্ঠস্বর, যেন সে আমাকে বলছে: “এখানে আমাদের আত্মা শুয়ে থাকবে, কেউ যেন এ পবিত্র মাটির উপর হাত না দেয়!” আজ, সেই একান্ত আর্জি ও আবেগকে পূর্ণ শ্রদ্ধা জানাতে, আমি লিখছি।
বহু বছর ধরে সাংবাদিকতা করেছি, বহু লেখাই লিখেছি, কিন্তু এই লেখা সেসব লেখার মতো নয়। এই লেখা একটি আদর্শ, একটি পারিবারিক সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা, যা আমাদের ঐতিহ্য ও শেকড়ের সাথে সম্পর্কিত। এখানে আমি শুধু কাগজে কলমে নয়, হৃদয়ে ভরা দুঃখ ও ক্রোধের সাথে লিখছি। আমাদের কবরস্থান, যেখানে প্রাচীন এক ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে আমার পূর্বপুরুষ শুয়ে আছেন, আজ সেই কবরস্থান দখল করে নেওয়ার পায়তারা চলছে। আমি এই অবিচারের বিরুদ্ধে কলম তুলে ধরছি—এটা শুধু আমার পরিবারের, আমার গোষ্ঠীর নয়, এই মাটির প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক।
আজ আমি এই লেখাটি লিখেছি, এক সন্তান হিসেবে, যার হৃদয়ে তার পূর্বপুরুষদের স্মৃতি অমলিন।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ—একটি প্রাচীন গ্রাম, যা শুধু একটি গ্রামের পরিচয়ে আটকে নেই, বরং এটি এক জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী। এই গ্রামে যে কবরস্থানটি আছে, তা আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতির প্রতীক, আমাদের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। চরণদ্বীপের নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর পারিবারিক কবরস্থান প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো, এটি শুধু মৃতদের ঠাঁই নয়, বরং জীবিতদের ইতিহাসের অংশ, তাদের গৌরবময় অতীতের অমর সাক্ষী। এখানেই শায়িত আছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা, যাদের অবদান ছাড়া আজকের আমরা সম্ভব হতাম না।
কিন্তু আজ সেই কবরস্থানে অযাচিতভাবে হাত পড়েছে। প্রশাসনের উদাসীনতায়, দখলদারের লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়েছে এই পবিত্র ভূমি। সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক অযৌক্তিক
এসিল্যান্ড কতৃক মৌখিক ভাবে জনসাধারণকে কবরস্থান উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত জারি করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, “এখন থেকে কবরস্থানের মধ্যে দিয়ে হাঁটা চলার রাস্তা করা হবে।” এই সিদ্ধান্তের পিছনে উদ্দেশ্য কি? আসলেই কি এটি এলাকার জনগণের কল্যাণে নেওয়া হয়েছে, না কি এটি কেবল কিছু লোকের স্বার্থে নেয়া একটি খেলা?
একটি কবরস্থান কেবল মৃতদের ঠাঁই নয়, এটি জীবিতদের ইতিহাস, তাদের শিকড়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চরণদ্বীপের কবরস্থান আমাদের পূর্বপুরুষদের ত্যাগ, পরিশ্রম, প্রেম, এবং শোকের স্মৃতি ধারণ করে। এখানকার প্রতিটি শ্যাওলা ধরা পাথর, প্রতিটি পুরোনো সমাধি ফলক, সমস্ত কিছু এক একটি গল্প বলে—কখনো বীরত্বের, কখনো ত্যাগের, কখনো প্রেমের, কখনো সংগ্রামের। এই কবরস্থান আমাদের রক্তের টান, আমাদের আত্মার ঠিকানা। এখানে দাঁড়িয়ে, আমরা অনুভব করি আমাদের শিকড়ের শক্তি এবং আমাদের অস্তিত্বের গৌরব। তবে এখন যখন এই ঐতিহাসিক কবরস্থানের পবিত্রতায় আঘাত আসছে, তখন চরণদ্বীপের নজর মোহাম্মদ গোষ্ঠীর পরিবারবর্গ চুপ থাকতে পারে না। তাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকা শিকড় তাদের বাধ্য করেছে একত্রিত হতে, এবং তারা এই কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষায় নিজেদের জীবনের শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালানোর অঙ্গীকার করেছে। “কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের লড়াই কখনো থামবে না,” এই দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিয়েছে যে, তাদের এ লড়াই শুধু কবরস্থানের রক্ষার জন্য নয়, এটি একটি বৃহত্তর সংগ্রাম—একটি জাতির শিকড় রক্ষার সংগ্রাম।
অথচ, এই কবরস্থানের ওপর যদি দখলদারদের লোভী পথ চলতে থাকে, তবে আমাদের শিকড় একে একে মুছে যাবে। এই কবরস্থান যদি হারিয়ে যায়, তাহলে শুধু একটি স্থান নয়, আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যও ধ্বংস হবে। এখানকার কবরগুলো আমাদের আত্মার ঠিকানা, আমাদের ইতিহাসের পবিত্র এক অঙ্গ। তাই আজ, যখন দখলদাররা এই ঐতিহাসিক স্থানটি নিজের করে নিতে চাচ্ছে, তখন চরণদ্বীপের মানুষ এক হয়ে তাদের পবিত্রতা রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। প্রশাসনকে তারা সতর্ক করে দিয়েছে, “এটি দখলদারের খেলার জায়গা নয়। কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে প্রশাসন যদি নীরব থাকে, তবে আমাদের আন্দোলন আরও প্রবল হবে। আমরা এই কবরস্থানের শান্তির ঘুম নষ্ট হতে দেব না।” তাদের দৃঢ় বার্তা, যদি প্রশাসন নির্বিকার থাকে, তবে এই আন্দোলন শুধু চরণদ্বীপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি আরও বৃহত্তর আকার ধারণ করবে।
এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, প্রশাসন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুক, যাতে কবরস্থানের পবিত্রতা সুরক্ষিত থাকে। দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং এসিল্যান্ডের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক। যদি প্রশাসন এই সমস্যার সমাধান না করে, তবে চরণদ্বীপের মানুষ আরো বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলবে, এবং কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করবে না।
এই লড়াই শুধু একটি কবরস্থান রক্ষার জন্য নয়, এটি একটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম। আমরা আমাদের শিকড় রক্ষা করব, আমাদের পূর্বপুরুষদের শান্তির ঘুম নষ্ট হতে দেব না। এটি আমাদের আত্মার ঠিকানা, এটি আমাদের শিকড়, এবং এই শিকড় কোনো দখলদার ছিঁড়ে ফেলতে পারবে না, যদি আমরা একসঙ্গে দাঁড়াই।
এখন প্রশ্ন উঠছে, যদি প্রশাসন তাদের খাসজমি দাবি করে কবরস্থানের দখল নিতে চায়, তাহলে কি আমরা চুপ থাকব? ৩০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের জমিতে এই কবরস্থান স্থাপন করেছিলেন, এবং এটি কখনোই খাসজমি ছিল না। এখন যদি কোনোভাবে কিছু অংশ খাস খতিয়ান অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তাতে কি আমাদের বাপদাদাদের কবরসহ পুরো কবরস্থানের মালিকানা চলে যাবে? আমাদের একটাই দাবি—আমাদের বাপদাদাদের কবরগুলো ফেরত দিন, এবং তাদের শান্তির ঘুম নষ্ট হতে দেবেন না।
এই সংগ্রাম কেবল চরণদ্বীপের মানুষের নয়, এটি আমাদের সবার সংগ্রাম। এটি আমাদের শিকড় রক্ষা করার লড়াই, আমাদের ইতিহাস রক্ষা করার লড়াই, এবং আমাদের আত্মার শান্তি রক্ষা করার লড়াই।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।