রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সমাজের অন্ধকারও
ঘনীভূত হয়। হয়তো এখনই কোথাও একটি মেয়ে নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছে, হয়তো কোনো শিশু তার নিরীহ চোখে ভয় আর যন্ত্রণা লুকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র কি জানে, জানলেও কি সে শোনে?
একজন নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয়, তখন তার ওপর নেমে আসে একরাশ অন্ধকার। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, তার যন্ত্রণার যাত্রা সেখানেই শেষ হয় না—বরং নতুন এক বিভীষিকার দরজা খুলে যায়। একজন ধর্ষিতা একবার ধর্ষিত হয় শরীরের মাধ্যমে, কিন্তু বিচারব্যবস্থা, সমাজ, প্রশাসন এবং আইনজীবীদের মাধ্যমে সে বারবার ধর্ষিত হয়।হাসপাতালে এক নারীর অসম্মান: যে যন্ত্রণা কেবল ভুক্তভোগী বোঝে ধর্ষণের পর এক নারীর প্রথম গন্তব্য হাসপাতাল। সমাজ মনে করে, হাসপাতাল ন্যায়বিচারের প্রথম ধাপ, কিন্তু বাস্তবে তা হয় এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সূচনা। চিকিৎসকের রুমে ঢুকতেই তার শরীর যেন আর নিজের থাকে না। তার শরীরে খোঁজা হয় "প্রমাণ", তার কষ্টের কোনো মূল্য নেই। কাপড় খুলতে বলা হয়, নিথর শরীরে বসে থাকতে হয়। তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে একদল চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, হাসপাতালের অন্য কর্মচারী—সবার দৃষ্টিতে যেন এক নিষ্প্রাণ দেহ, একখণ্ড মাংসপিণ্ড হয়ে ওঠে সে। ডাক্তারের হাতে তার ভাগ্য। রিপোর্টে যদি লেখা হয়—"শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি"—তাহলে তার সমস্ত লড়াই সেখানে শেষ। সে যতই চিৎকার করুক, যতই বিচার চায়—তার কথার কোনো মূল্য নেই। কারণ আদালতে দাঁড়িয়ে সে প্রমাণ করতে পারবে না যে, সে সত্যিই ধর্ষিত হয়েছে। কারণ ধর্ষণের চিহ্ন সবসময় শরীরে থাকে না, কিন্তু মানসিক ক্ষত থেকে যায় সারাজীবন।
পুলিশের সামনে ধর্ষিতার দ্বিতীয় ধর্ষণ
এরপর তাকে যেতে হয় থানায়, পুলিশের জেরার সামনে দাঁড়াতে হয়। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী কি জানত, থানায় গিয়েও তাকে মানসিকভাবে আরেকবার ধর্ষিত হতে হবে? পুলিশ কর্মকর্তা যদি সহানুভূতিশীল হয়, তাহলে সে হয়তো তার জবানবন্দি নিতে কৌশলী হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ তাকে এমন সব প্রশ্ন করে, যা নতুন করে তার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দেয়।
"তুমি কিভাবে ধর্ষণের শিকার হলে?"
"তুমি কি প্রতিরোধ করেছিলে?"
"তুমি কি চিৎকার করোনি?"
"তুমি কি আগে থেকেই তাকে চিনতে?"
"তুমি কোথায় ছিলে, কেন সেখানে গিয়েছিলে?"
প্রশ্নগুলো এমনভাবে করা হয় যেন ধর্ষণের জন্য নারী নিজেই দায়ী!
এরপর তাকে পাঠানো হয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিতে। সেখানে যদি সে সামান্য ভুলও করে ফেলে, তাহলে পুরো মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। ধর্ষিতা যদি মানসিক চাপে কিছু বলতে ভুলে যায়, যদি তার কথা পুলিশের বক্তব্যের সঙ্গে না মেলে, তাহলে ধর্ষকের পক্ষের আইনজীবীরা সেটাই অস্ত্র বানিয়ে তাকে আক্রমণ করবে।
আদালতে ধর্ষণের চূড়ান্ত বিচার নাকি চূড়ান্ত অপমান?
বিচারের জন্য তাকে যেতে হয় আদালতে
কিন্তু আদালত কি তার জন্য ন্যায়বিচারের জায়গা, নাকি নতুন করে আরেকটা যুদ্ধক্ষেত্র? সেখানে দাঁড়িয়ে একজন নারীকে লড়াই করতে হয় শক্তিশালী উকিলদের বিরুদ্ধে।
কালো কোট পরা এক উকিল তার দিকে তাকিয়ে বলে—
"তোমার শরীরের কোন অংশে আগে হাত দিয়েছিল?"
"কোন হাত দিয়ে ধরেছিল?"
"কতক্ষণ ধরে ধর্ষণ করেছিল?"
"তুমি তখন কী করছিলে?"
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ধর্ষিতা বুঝতে পারে, সে আসলে বিচার চাইতে আসেনি—সে যেন নিজেই অভিযুক্ত! আদালতে যেন সে নিজেই অপরাধী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শিশুরা কীভাবে বুঝাবে তার ওপর চালানো পাশবিকতা?
একটি প্রাপ্তবয়স্ক নারী হয়তো তবু বোঝাতে পারে কী ঘটেছে তার সঙ্গে, কিন্তু শিশুরা কী করবে? পাঁচ বছরের শিশুকে কীভাবে প্রশ্ন করা হবে—"তোমার গায়ে হাত দিয়েছে কিভাবে?" "কোথায় স্পর্শ করেছে?"
শিশুদের ভাষা হয়তো এত স্পষ্ট নয়, কিন্তু তাদের চোখের জলই বলে দেয় কতটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা গিয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার শিশুদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
পরিসংখ্যানের ভয়াবহতা: আমরা কতটা পিছিয়ে?
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ছয় হাজারের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয়ে সাতজন নারী আত্মহত্যা করেছেন, ১০৯ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন, এবং একজন ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৮৯ জন নারী নির্যাতিত হয়েছেন। প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন গড়ে ১২টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে, অর্থাৎ পুরো মাসে প্রায় ৩৩৬টি ধর্ষণ মামলা।
কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়—এই সংখ্যাগুলো কি সত্যিই পুরো চিত্র তুলে ধরে? না, ধরে না। কারণ সমাজের লজ্জা, ভয় এবং বিচারহীনতার কারণে শত শত ঘটনা লুকিয়ে থাকে, কখনোই প্রকাশ পায় না।
আমরা কি পারি পরিবর্তন আনতে?
ধর্ষণ বন্ধের জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, আইন করা হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন:
ডিএনএ পরীক্ষার বাধ্যতামূলক ব্যবহার—যাতে ধর্ষণের শিকার নারীদের বারবার প্রমাণ দিতে না হয়।
থানা, হাসপাতাল ও আদালতে ধর্ষিতাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা—যাতে তাদের আরেকবার অপমানিত হতে না হয়।
বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা—বছরের পর বছর মামলা চলতে থাকলে ধর্ষিতারা কখনোই ন্যায়বিচার পায় না।
সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের সমর্থন—ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে।
ধর্ষিতারা ন্যায়বিচার চায়, করুণা নয়। তারা প্রতিশোধ চায় না, তারা নিরাপত্তা চায়। আমাদের সমাজ কি প্রস্তুত সেই নিরাপত্তা দিতে? রাষ্ট্র কি ধর্ষিতার পাশে দাঁড়াবে, নাকি ধর্ষকের দিকেই তাকিয়ে থাকবে?
আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই, নয়তো আমাদের সন্তানদেরও একদিন এই বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com