গল্পে গল্পে জীবন কথাঃ
"নারীর সাথে আড়ি"
মো.কামাল উদ্দিনঃ
প্রথম অধ্যায়: জন্ম যন্ত্রণা
রূপসা জন্ম নেয় এক ঝড়বৃষ্টির রাতে। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছিল, খড়ের ঘরের চাল ফুটো হয়ে বৃষ্টির ধারা ভিতরে প্রবেশ করছিল। সে মুহূর্তে তার মা যন্ত্রণায় কাঁপছিলেন, যেন প্রকৃতিও তার কষ্টের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। দাইমা বলেছিল, “মেয়ে হইছে, কপাল খারাপ! ছেলের আশা কইরা কি হইলো?”
রূপসা যখন প্রথম চোখ খুলে দেখল এই পৃথিবী, তখনই যেন শোনে প্রথম অভিশাপ—সে মেয়ে হয়ে জন্মেছে! বাবা, যে তার জন্য ফসলের মাঠে শ্রম দিয়েছিল, সে মুখ ফিরিয়ে নিল। মা—যিনি জীবন দিয়ে
তাকে জন্ম দিলেন—তিনিও অপমানের ভারে চোখ নামিয়ে নিলেন। এই ছিল রূপসার জন্মের ইতিহাস।
দ্বিতীয় অধ্যায়: সমাজের আড়ি
রূপসা বড় হলো একটা দমবন্ধ পরিবেশে। সে যখন পাঁচ বছরে পা দিল, তখন থেকেই তাকে শেখানো হলো—“মেয়ে হয়ে বেশি হাসাহাসি করা ঠিক না, বেশি জোরে কথা বলা বেয়াদবি।”
সে যখন স্কুলে যেতে চাইলো, বাবা বলল, “মেয়েদের এত লেখাপড়া শিখে কী হবে? শেষমেশ তো অন্যের ঘরেই যাবে।”
তবুও মা লুকিয়ে স্কুলে পাঠাতেন, কিন্তু পথটা ছিল কাঁটার মতো কঠিন। স্কুলের পথ ধরে হাঁটতে গেলে ছেলেরা পেছন থেকে খোঁচা দিত, কটুক্তি করত। রূপসা বুঝত না, তার দোষ কী? শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই?
তৃতীয় অধ্যায়: প্রেম ও প্রতারণা
বয়স বাড়তে লাগল, রূপসা এখন কিশোরী। চুলে বেণি করে স্কুলে গেলে পাশের গ্রামের ছেলেরা তাকে দেখে হেসে বলত, “রূপসার চুল যেন সাপের মতো লম্বা, চোখ যেন ডাগর ডাগর, মেয়েটা বড় সুন্দর!”
একদিন এক যুবক, নাম তার আরমান, তাকে বলল, “তোমার চোখে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, রূপসা! আমার জীবনটাও তোমার চুলের মতো শক্ত বাঁধনে বাঁধা পড়ুক।”
রূপসা প্রথমবারের মতো অনুভব করল প্রেম। কিন্তু সে জানত না, এই প্রেমও এক ধরনের আড়ি।
দিন যেতে লাগল, রূপসা আরমানের প্রতি গভীর বিশ্বাস রাখল। কিন্তু একদিন জানতে পারল, আরমান শুধু তাকে নয়, আরও অনেক মেয়েকেই একই কথা বলে। সমাজের চোখে সে এখন কলঙ্কিত!
চতুর্থ অধ্যায়: পণ্যের মতো নারী
বাবা আর সমাজের প্রবীণরা মিলে সিদ্ধান্ত নিল—রূপসার বিয়ে হবে। কোনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি তাকে। আর্থিক সংকটের কারণে বাবা মোটা অঙ্কের যৌতুক গ্রহণ করল, আর রূপসা এক অচেনা ঘরে পাড়ি দিল।
স্বামী প্রথম দিন বলল, “তোমাকে আমি স্ত্রী হিসেবে এনেছি, কিন্তু নিজের মতো চলতে দিও না। আমি যা বলব, তাই শুনবে।”
রূপসার কল্পনায় স্বপ্নের সংসার ছিল, যেখানে সে ভালোবাসা পাবে, নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে বুঝল, তার নতুন পরিচয় ‘বউ’ নয়, বরং ‘কাজের লোক’।
পঞ্চম অধ্যায়: প্রতিরোধ
বছর ঘুরে গেল, রূপসা এখন এক সন্তানের মা। তবুও অত্যাচার থামল না। এক রাতে স্বামী তাকে প্রচণ্ড মারধর করল। তার অপরাধ? সে প্রতিবাদ করেছিল!
সেই রাতেই রূপসা সিদ্ধান্ত নিল—আর নয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই সে সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘর ছাড়ল। এই সমাজ, যা তার সাথে বারবার আড়ি দিয়েছিল, সেই সমাজের চোখে চোখ রেখে বলল, “নারীর সাথে আর আড়ি নয়, নারীরাও মানুষ।”
শেষ অধ্যায়: নতুন সূর্যোদয়
রূপসা শহরে এসে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। ছোট চাকরি করল, সন্তানের জন্য সংগ্রাম করল। সে প্রমাণ করল, নারী কোনো পুরুষের করুণা নয়, নারীও শক্তিশালী।
তার কন্যা, নীলা, একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে বলল, “মা, আমাদের ক্লাসের বইয়ে পড়লাম—‘নারী হলো জাতির মেরুদণ্ড’। সত্যি কি তাই?”
রূপসা হাসল, চোখে জল এলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি একদিন সমাজের আড়ি ভেঙে পথচলা শিখবে, মা। নারীরা মানুষ, নারী আর কোনোদিন পণ্য হবে না।”
সমাপ্ত-এই উপন্যাস নারীদের শক্তির কথা বলে, সংগ্রামের কথা বলে। সমাজ যতবারই নারীর সাথে আড়ি দেবে, ততবারই রূপসার মতো কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে বলবে—‘নারীর সাথে আড়ি নয়, নারীরাও মানুষ।’
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com