৭ মার্চের ভাষণ: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও বর্তমান বাস্তবতা-
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তা শুধু একটি বক্তৃতা ছিল না—এটি ছিল স্বাধীনতার ডাক। তাঁর কণ্ঠস্বরে বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা উচ্চারিত হয়েছিল। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”—এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ টিকে থাকল কতটা? তাঁর আদর্শের উত্তরাধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হয়েছে, আর কতটুকু বিকৃত হয়েছে? শেখ হাসিনা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধরে রাখতে পেরেছেন?
শেখ হাসিনা নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরসূরি হিসেবে দাবি করেন, কিন্তু গত ১৫ বছরের শাসনে তিনি কতটা সেই আদর্শ অনুসরণ করেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, স্বাধিকার এবং মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন। অথচ শেখ হাসিনার শাসনামলে বারবার বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। একদলীয় শাসনের দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন, মুক্তচিন্তা এবং রাজনৈতিক উদারতা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আজ বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন—এসবই এক ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি করেছে, যা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে একেবারেই সংগতিপূর্ণ নয়।
বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমান: ইতিহাসের মূল্যায়ন-
বঙ্গবন্ধু কখনো মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদানকে অস্বীকার করেননি। বরং তিনি তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যা তাঁর প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থার প্রকাশ ছিল। অথচ শেখ হাসিনার শাসনামলে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা বারবার অস্বীকার করা হয়েছে, এমনকি তাঁর স্বাধীনতা যুদ্ধের অবদানও খাটো করার চেষ্টা করা হয়েছে।
অন্যদিকে, জিয়াউর রহমানও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শন করেননি। তিনি সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি কখনো ৭ মার্চের ভাষণকে অস্বীকার করেননি, বরং সেই ভাষণের পর সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল।
৭ মার্চের ভাষণের প্রকৃত তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট-
৭ মার্চের ভাষণ মুক্তির ভাষণ, স্বাধীনতার ডাক। এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের সম্পত্তি নয়, এটি সমগ্র জাতির ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না, এটি ছিল স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা, যার বাস্তব রূপ দিতে সৈনিক-জনতা একসঙ্গে অস্ত্র ধরেছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ সেই ভাষণ নিয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। ৭ মার্চের যে চেতনা, তা যদি আমরা সত্যিকার অর্থে ধারণ করতাম, তাহলে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হতো, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকত, এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির রাজনীতি বন্ধ হতো। সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা এক নয়-বঙ্গবন্ধু যেখানে গণতন্ত্র ও জনগণের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে সেই গণতন্ত্রই সংকুচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর চেতনা ছিল মুক্তির, কিন্তু বর্তমান শাসনামলে মুক্ত চিন্তার জায়গা সঙ্কুচিত হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক অধ্যায়। এটি কোনো রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, বরং জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত একটি ঐতিহাসিক সত্য। এই সত্যকে বিকৃত না করে, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়া সম্ভব হবে, যেখানে জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবে। ইতিহাস কখনো নিছক ঘটনার ধারাবাহিকতা নয়, এটি একেকটি জাতির আত্মপরিচয়ের সোনালি অধ্যায়। কিছু মুহূর্ত এমন থাকে, যা একটি জাতির ভাগ্য বদলে দেয়, তাকে পথ দেখায়, তাকে সংগ্রামের মন্ত্র শেখায়।
সেই রকমই এক অমর মুহূর্ত ছিল ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। ঢাকার রমনা এলাকার রেসকোর্স ময়দান—যেখানে একসময়ে ঘোড়দৌড় হতো, সেদিন সেখানে অপেক্ষা করছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাদের হৃদয়ে বয়ে যাচ্ছে উত্তাল প্রতীক্ষার স্রোত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন, বলবেন কী? এই প্রশ্ন তখন গোটা বাংলার মানুষের হৃদয় দখল করে রেখেছে। মঞ্চ প্রস্তুত। চারদিকে উত্তেজনা। বাতাসে এক চাপা রোমাঞ্চ।
সেই মুহূর্তেই, সময়ের দাবিতে, ইতিহাসের প্রয়োজনেই উচ্চারিত হলো সেই অমর ভাষণ—যা কেবল কিছু শব্দের সমষ্টি নয়, এক মহাকাব্যিক আন্দোলনের জন্ম। প্রথম অধ্যায়: পূর্ব বাংলার বুকে বঞ্চনার দীর্ঘ ছায়া- এই ভাষণ কোনো হঠাৎ করে উচ্চারিত কিছু ছিল না। এর শেকড় প্রোথিত ছিল ইতিহাসের বহু গভীরে। ১৯৪৭ সালের বিভাজন, পাকিস্তানের জন্ম, তারপর বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের একের পর এক অন্যায় দমননীতি—এই ভাষণ যেন তারই জবাব দিতে এসেছিল। ১৯৫২-তে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন, ১৯৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ১৯৬৬-তে ছয় দফার আহ্বান, ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান—এই প্রতিটি ঘটনা ধাপে ধাপে বাঙালির জাতীয়তাবোধকে পুষ্ট করছিল।
কিন্তু চূড়ান্ত সংকট শুরু হলো ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর। সারা বাংলার মানুষ একসঙ্গে রায় দিয়েছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৭টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই গণরায় মেনে নিতে পারল না।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টো ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে লাগল। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা বাতিল করা হলো। বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে উঠল। ৫ মার্চে সারাদেশে হরতাল হলো। ৬ মার্চ জাতির সামনে এসে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, “২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হবে।” কিন্তু ততক্ষণে বাঙালির হৃদয়ে জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনার ইতিহাস এক মহাসাগরে রূপ নিয়েছে। আর সেই সাগরের ঢেউকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন একমাত্র একজন নেতা—শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ৭ মার্চের ভাষণ ছিল সময়ের দাবিতেই এক অনিবার্য উচ্চারণ।
দ্বিতীয় অধ্যায়: এক ভাষণে স্বাধীনতার সূচনা-"ভাইয়েরা আমার!" মাত্র তিনটি শব্দ—কিন্তু তাতে ছিল এক গভীর মমতা, দৃঢ় প্রত্যয় এবং নেতৃত্বের অভূতপূর্ব শক্তি।
লক্ষ লক্ষ মানুষ নীরব হয়ে গেল।
সেই দিন, সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি এই দেশের মানুষের অধিকার চাই।”
তিনি বলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, তবুও এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।” এই একবাক্যেই যেন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল। তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানালেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছিল ভাষণের শেষ দিকে—
“প্রতিটি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।” এটি ছিল কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা, যদিও তিনি সরাসরি 'স্বাধীনতা' শব্দটি উচ্চারণ করেননি। কিন্তু লক্ষ মানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার অগ্নিশিখা জ্বলে উঠলো।
বঙ্গবন্ধু বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রেসকোর্স ময়দান যেন এক মুহূর্তে স্বাধীন বাংলার রাজধানীতে পরিণত হলো। তৃতীয় অধ্যায়: বিশ্বজোড়া প্রতিধ্বনি- এই ভাষণের তাৎপর্য শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে তখন ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রভাব। পাকিস্তান ছিল আমেরিকার মিত্র, আর ভারত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ। তাই আমেরিকা ও চীন চাইছিল না যে পাকিস্তান ভেঙে যাক। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলো এক নতুন বাস্তবতা—বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে, তারা অধিকার আদায় করবেই। বিশ্বের বিখ্যাত পত্রিকাগুলো এ ভাষণের বিশ্লেষণ করলো। নিউজউইক শেখ মুজিবকে আখ্যা দিল "Poet of Politics", অর্থাৎ রাজনীতির কবি। এই ভাষণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর একে বিশ্ব স্মৃতির আন্তর্জাতিক নিবন্ধন (Memory of the World Register) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
চতুর্থ অধ্যায়: ভাষণের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া- ৭ মার্চের পর বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে গেল। ৮ মার্চ থেকে সরকারি অফিসে কালো পতাকা উড়লো। ১৪ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে টানা অসহযোগ আন্দোলন চললো। ২৩ মার্চ, যেদিন পাকিস্তান দিবস পালন করা হলো, সেদিন ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হলো।
এদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে গেল।
২৫ মার্চ গভীর রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হলো।
সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, যা ২৬ মার্চ ভোরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলো। এভাবে ৭ মার্চের ভাষণ এক ঐতিহাসিক সেতুবন্ধ রচনা করলো—যার একদিকে ছিল স্বাধিকার আন্দোলন, আর অপর প্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত অধ্যায়।
এক অমর দলিল-
৭ই মার্চের ভাষণ ছিল এক সাহসী জাতির বীরত্বগাথা। এটি কোনো কাগুজে ঘোষণা ছিল না, ছিল এক জাতির স্বপ্ন ও সংগ্রামের অঙ্গীকার।
সেই ভাষণের প্রতিটি শব্দ আজও বাঙালির রক্তে বহমান। সেই ভাষণের শক্তিতেই একদিন এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আর আজও, যখন কোনো অন্যায়, কোনো নিপীড়ন এই জাতির সামনে আসে, তখন সেই কণ্ঠস্বর যেন বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়—
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম!”
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com