রাত তখন গভীর।
বাইরে ঝরছে টিপটিপ বৃষ্টি। ধানমন্ডির এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ভেতর বসে আছেন ব্যবসায়ী কামরুল হাসান। তার সামনে ছড়ানো পাঁচশো, এক হাজার, পাঁচ হাজার টাকার বান্ডিল—চোখ ঝলসে দেওয়া দৃশ্য। এত টাকা যে গুনতে হয় না, ওজনেই বোঝা যায়!
কিন্তু টাকার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে কামরুলের শান্তি। একসময় তিনি ছিলেন সৎ, সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে লোভের ফাঁদে পা দিলেন। প্রথমে সরকারি প্রকল্প থেকে কিছু টাকা সরিয়ে নেওয়া, তারপর ব্যাংক থেকে ভুয়া কাগজে লোন জালিয়াতি—এভাবেই অগাধ সম্পদের মালিক বনে গেলেন তিনি। ক্ষমতাবানদের সঙ্গে হাত মেলানো, দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়া—এগুলো ছিল যেন এক নেশা।
কিন্তু আজ এই বিশাল অর্থ-সম্পত্তি তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। টাকার গন্ধেই যেন লুকিয়ে আছে ভয়, অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা। ঘুমানোর আগে বারবার মনে হয়, কেউ দরজা ভেঙে ঢুকবে না তো? কেউ প্রতিশোধ নিতে ওঁৎ পেতে নেই তো? একদিন গভীর রাতে ফোন বাজল। অপরিচিত নম্বর। কামরুল ধীর হাতে রিসিভ করলেন। গলা একেবারে ঠান্ডা—
"আপনার সব খবর আমাদের জানা আছে। রাতের বেলা টাকা গুনবেন না, হিসাব মিলবে না!"হাত থেকে ফোন পড়ে গেল কামরুলের। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। জানালার বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা নয়, তারই অতীতের ভুলগুলো যেন টুপটাপ আঘাত করছে। টাকা আজ তার কাছে আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ! টাকা কি সত্যিই সুখ এনে দেয়? নাকি একেকটি নোট হয়ে ওঠে একেকটি অভিশপ্ত পয়সা, যা রাতে ঘুম কেড়ে নেয়?
টাকা দিবস: মুদ্রার ইতিহাস ও গুরুত্ব
বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪ মার্চ পালিত হয় "টাকা দিবস"। ১৯৭২ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক নোট প্রকাশিত হয়েছিল। এর আগে পাকিস্তানি রুপি প্রচলিত ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের পর 'টাকা' নামে আত্মপ্রকাশ করে। ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে "টাকা দিবস" পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
১৯৭২ সালের ৪ মার্চ প্রকাশিত ১ টাকার নোটে ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র ও 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' লেখা, যা তৎকালীন অর্থসচিব কে এ জামান স্বাক্ষরিত। আর ১০০ টাকার নোটে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও বাংলাদেশের মানচিত্র, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর এ এন হামিদ উল্লাহ স্বাক্ষরিত।
এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো জাতীয় মুদ্রার গুরুত্ব উপলব্ধি করা, টাকার সঠিক ব্যবহার ও সংরক্ষণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। টাকা শুধু লেনদেনের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক।
টাকার বিবর্তন: বিনিময় ব্যবস্থা থেকে ডিজিটাল লেনদেনঃ
আদিকাল:
টাকার জন্ম হয়নি তখনও। মানুষ বিনিময় প্রথায় লেনদেন করত, যা বার্টার সিস্টেম নামে পরিচিত। একজন কৃষক গরুর বিনিময়ে চাল নিতেন, আবার একজন কামার লোহার অস্ত্র দিয়ে শস্য সংগ্রহ করতেন। কিন্তু এতে সমস্যা ছিল—দুই পক্ষের প্রয়োজনীয় জিনিস সবসময় পাওয়া যেত না।
প্রাচীন মুদ্রা:
এই সমস্যার সমাধানে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক, রোমান, চীনা, ও ভারতীয় সভ্যতায় স্বর্ণ, রৌপ্য, তামার মুদ্রা ব্যবহৃত হতো। বাংলা অঞ্চলে শেরশাহ প্রথমবারের মতো "রূপিয়া" মুদ্রা চালু করেন, যা ব্রিটিশ শাসনে রুপিতে রূপান্তরিত হয়।
বাংলাদেশের মুদ্রার ইতিহাস:
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানি রুপি প্রচলিত হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে "টাকা" নামে নতুন মুদ্রা চালু হয়।
১৯৭২ সালে প্রথম ১, ৫, ১০, ১০০ টাকার নোট বাজারে আসে।
২০০০-এর দশকে আসে প্লাস্টিক নোট ও ডিজিটাল লেনদেনের যুগ।
আজকের বিশ্ব ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে। ডিজিটাল ট্রানজেকশন, ক্রিপ্টোকারেন্সি, মোবাইল ব্যাংকিং—সবকিছুই বদলে দিচ্ছে টাকার ব্যবস্থাপনা।
টাকার মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
একসময় এক টাকায় অনেক কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ১০০ টাকা দিয়েও সামান্য কিছু কেনা সম্ভব নয়! এর কারণ মুদ্রাস্ফীতি।
মুদ্রাস্ফীতির কারণ:
সরকার অতিরিক্ত টাকা ছাপালে মুদ্রার মূল্য কমে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমলে টাকার অবমূল্যায়ন হয়।
পণ্যের উৎপাদন কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও ঋণখেলাপির কারণে মুদ্রাস্ফীতি তীব্র হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জ:
ডলার সংকট: বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়ছে, রপ্তানি আয় কমছে। ব্যাংকিং দুর্নীতি: খেলাপি ঋণ, মানিলন্ডারিং, ব্যাংক লুট অর্থনীতিকে দুর্বল করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ছে।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ: টাকার ভবিষ্যৎ কোন পথে? বাংলাদেশে যদি সঠিক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে টাকার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব।
যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি: বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা – দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্য আনা – শুধু গার্মেন্টস শিল্পের ওপর নির্ভর না করে তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও ওষুধ শিল্পে রপ্তানি বাড়াতে হবে।
ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো – ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি করা – ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে এগোতে হবে।
শেষ কথা: টাকা কি সত্যিই সুখ এনে দেয়?
টাকা সভ্যতার অন্যতম চালিকা শক্তি। এটি শুধু লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং অর্থনীতির ভিত্তি। কিন্তু যদি অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে, তাহলে টাকা আশীর্বাদ থেকে অভিশাপে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে আমরা কীভাবে টাকা ব্যবহার করছি? এটি কি আমাদের স্বস্তি দিচ্ছে, নাকি অস্থিরতা তৈরি করছে? কামরুল হাসানের গল্প কি আমাদের কোনো শিক্ষা দেয়?
শুধু টাকা কামানোর চিন্তা নয়, বরং টাকার সঠিক ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। তাহলেই টাকা হবে সমৃদ্ধির প্রতীক, ভয় বা অভিশাপের নয়।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com