জীবনের শেষ বয়সে এসে যখন আমরা ফিরে তাকাই, তখন মনে হয়, কত কিছুই তো ভুল করেছি। ছোট ছোট ভুলগুলো, যেগুলো তখন অতি তুচ্ছ মনে হতো, আজ সেগুলো আমাদের অন্তরে গভীর দাগ রেখে গেছে। জীবন যেন একটি দীর্ঘ পথচলা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা কিছু না কিছু শিখে, কিছু না কিছু হারিয়ে ফেলি। যখন সে পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছাই, তখন অনুভব করি—বহু কাজ, বহু সিদ্ধান্ত আমাদের জীবনের অমূল্য মুহূর্তগুলো ছিনিয়ে নিয়েছে। এক হাত জমির জন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া ছিল ভুল। এমন এক ঝগড়ার জন্য যা আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি নষ্ট করেছে, আর সেটা একদিন কোনো অর্থই রাখেনি। ওই জমির শীতল মাটি থেকে কোনদিন শান্তি আসেনি, কিন্তু আমাদের মন থেকে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। জীবন তখন আর জমি বা জায়গা নিয়ে নয়, সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু আমরা তখন জানতাম না, এই ছোট্ট ঝগড়া একদিন আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে দাঁড়াবে। রাত জেগে অযথা চ্যাটিং করতে করতে একসময় ভেবে পাই না, আমি কতটা সময় হারিয়ে ফেলেছি। যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ডগুলো আমাদের সুখী বা সফল করে তোলেনি, তখন মনে হয়, জীবনটা কীভাবে যেন অন্যদিকে চলে গিয়েছিল। আমরা যাকে সময় দিয়েছি, তার মধ্যে কিছুই টিকে থাকেনি। এমনকি, নিজের ভিতরের শান্তিকে পুনরুদ্ধার করা তো দূরের কথা, সামান্য কিছু সুন্দর মুহূর্তের জন্য ব্যস্ততা এমনভাবে আমাদের পিছু ছাড়েনি, যা আজ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কখনও-কখনও মনে হয়, দুর্বল কাউকে ভয় দেখানো কত বড় অন্যায় ছিল। শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে আমরা জানতাম না, একজন মানুষের আস্থা, তার সম্মান, সেটা তার সমস্ত জীবনের অমূল্য সম্পদ। সেই শক্তি, সেই ক্ষমতার প্রদর্শন কখনো সুখী করে না, কেবল একে অপরকে দুর্বল করে তোলে। আমরা ভাবতাম, আমাদের কর্তৃত্ব, আমাদের উপস্থিতি এমনকি অন্যদের উপর শক্তি প্রদর্শন আমাদের ভালো করে তুলবে, কিন্তু আসলে সেটি ছিল জীবনযাত্রার একমাত্র ভুল সিদ্ধান্ত, অথচ যখন জীবনের শেষ সময় আসে, তখন মনে হয়—যে কাউকে কষ্ট দিয়েছি, সে কষ্ট এখন আমার নিজের মনের গভীরে ভীষণভাবে অনুভূত হয়। আমরা জীবন যেভাবে কাটিয়েছি, আমরা একে অপরকে যেভাবে পেরেছি তুচ্ছ করতে, কষ্ট দিতে, সেগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত আজ আমাদের কাছে একটি অপ্রাপ্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, আমাদের জীবনে বড় মেধাবী না হওয়া বা খুব বেশি টাকা রোজগার না করা, এসব কিছুই শেষবেলায় মনে হয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। যখন ক্লাসের সেরা ছাত্র হওয়া, কিংবা জীবনের সবটুকু অর্থ উপার্জন করা আমাদের কাছে ছিল স্বপ্ন, তখন জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে ভাবি, এ তো কোনো ব্যাপারই ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভালো সম্পর্ক, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের ভালোবাসা পাওয়া। জীবনে এই সত্যি শান্তি, এই সত্যি স্বস্তি যা কোনো সম্পদ বা সাফল্যের সাথে মিলানো যায় না।
জীবনের সবথেকে মূল্যবান বিষয় ছিল মানুষের দোয়া, মানুষের বিশ্বাস। আমরা যারা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি নিজের জন্য, নিজের সুখের জন্য, নিজের অর্জনের জন্য, তাদের কাছে জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দান অনেক সময় অনুধাবন করা কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে এসে যখন এক মুহূর্তের জন্য শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তখন সেই দোয়ার অর্থ পুরোপুরি উপলব্ধি হয়। তখন মনে হয়, মানুষের ভালোবাসাই একমাত্র সত্যি সম্পদ, যা সব দুঃখ, কষ্ট, বিচ্ছেদ, অসুখ-বিসুখের মাঝে আমাদের মনের শান্তি এনে দেয়। অথচ এই সময়, যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত আসে, তখন জীবনের সবকিছু চলে যায়। শুধুমাত্র আমাদের আমল, আমাদের ভুল-শুদ্ধ, আমাদের কষ্ট-আনন্দগুলোই বেঁচে থাকে মানুষের মনে। জীবন কখনও ভাবতে বা ভেবেচিন্তে কাটানো যায় না, আমরা যে ভুলগুলো করেছি, তা কখনো শোধ হতে পারে না। তবে, যখন মৃত্যুর কাছে আসি, তখন সবার আগে যা দরকার তা হলো- মানুষের দোয়া, মানুষের ভালোবাসা। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, জীবন নানা ধাপে, নানা ভুলের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছে। যে ভুলগুলো কখনো মেনে নেয়া হয়নি, কখনো ভুল ভেবেছিলাম, সে সবই আমাদের জীবনের শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ আমরা যদি সেই শিক্ষা নিয়ে, কিছুটা সুস্থির হয়ে, কিছুটা পরিণত হয়ে জীবন যাপন করতে পারি, তবে তা হবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এইভাবেই জীবনের সব কিছু ভাবতে ভাবতে আমরা একদিন উপলব্ধি করি, জীবনের সত্যিকার অর্থ আসলে কোথায়।
জীবন একটি রহস্যময় যাত্রা, যেখানে আমরা নানা ভুল, ক্ষতি ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চলতে থাকি। তবে, প্রশ্ন আসতে পারে—এত ভুল করার পর কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়? কেন আমরা এসব ভুল করি, কেন কিছু সময় ভুল পথে চলে যাই, যেখানে আমাদের জন্য আসলে কিছুই নেই? আমাদের চারপাশের পৃথিবী, মানুষের সম্পর্ক, সব কিছুই যেন অস্থির, অস্থায়ী। একদিন চলে যেতে হবে, আর শেষমেশ শুধুমাত্র মৃত্যু থাকবে। তাহলে, কি আসলেই কোনো লাভ আছে?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, আমাদের প্রথমে আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। আমরা জীবনে ভুল করি কারণ আমাদের মনের গভীরে অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা কাজ করে। আমরা চেষ্টার পরেও মাঝে মাঝে কোনো কিছু খুঁজে পাই না। পৃথিবীটা আসলেই খুব সঙ্কটপূর্ণ জায়গা, যেখানে আমরা কখনো শান্তি পাই না। কখনো মনের অস্থিরতা, কখনো আশাহত হয়ে আমরা ভুল পথে চলে যাই। মানুষের মধ্যে একটি অদ্ভুত আশা থাকে—অর্থ, পরিচিতি, সম্পর্ক, প্রতিপত্তি—এসব দিয়ে যেন আমরা সুখী হতে পারি। কিন্তু এই প্রত্যাশাগুলোই আমাদের ভুলের দিকে ঠেলে দেয়।
আমরা মনে করি, আমাদের অর্জন, টাকা, সাফল্য বা অন্যের দৃষ্টি আমাদের সত্যিকারের আনন্দ এনে দেবে। অথচ, তা কখনো সত্যি হয় না। আমরা জীবনের অস্থিরতা থেকে পালাতে গিয়ে আরও বড় ভুলে জড়িয়ে পড়ি। আসলে আমরা সবসময়ই কিছু না কিছু খুঁজে চলি, কিন্তু কখনোই তার শেষটা না পেয়ে অস্থির হয়ে যাই। এর ফলে, সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা, কথা-কাটাকাটি, প্রতিযোগিতা—সব কিছুই আমাদের জীবনে ক্ষতি নিয়ে আসে। এটা সত্য, এই পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। যে সম্পর্কগুলো আমাদের কাছে প্রিয়, সেগুলোর কোনো স্থায়ীত্ব নেই। মানুষ আসে, চলে যায়, এবং একদিন সবারই চলে যেতে হয়। আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি যে একদিন সবাই চলে যাবে—এটা আসলে শাস্তির মতো, যার দিকে আমরা চাইলে বা না চাইলে চলে যাচ্ছি।
এখানে, পৃথিবীকে "মিথ্যা" বলা যায়, কারণ আমরা যেসব জিনিসে এতটা বিশ্বাস রেখে চলি, একদিন তা বদলে যাবে, উবে যাবে। টাকা, সাফল্য, ক্ষমতা—এইসব একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই দুনিয়াতে কখনোই কেউ কারো নয়। তবে, যেটি সত্যি, তা হলো—মৃত্যু।
এই মৃত্যুই আমাদের সত্যি, কিন্তু এই সত্যিটা আমরা মেনে নিতে ভয় পাই। কেউ আমাদের 'আপন' নয়, কিন্তু যখন আমরা এই সত্যি উপলব্ধি করি, তখন বুঝি—এটাই আমাদের শিখতে হবে। আমাদের সঠিক পথে চলতে হবে, নিজের অন্তরকে শান্ত রাখতে হবে, অন্যের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে, তবে কিছুটা শান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন আসে, আমরা কীভাবে এসব ভুল থেকে মুক্তি পাব, কীভাবে জীবনকে শান্তভাবে বাঁচব, এবং মনের শান্তি অর্জন করব?
১. আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মসমালোচনাঃ নিজের ভুলগুলো স্বীকার করতে শিখুন। যখন আমরা নিজেদের ভুল দেখতে পারি, তখন আমরা সেগুলো থেকে শিখতে পারি। শুধুমাত্র আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে।
২. সম্পর্কে সততা: মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল পারস্পরিক বিশ্বাস তৈরি করলে সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়। আমাদের মনের প্রশান্তির জন্যই প্রয়োজন একজন সত্যিকারের বন্ধু বা একজন আত্মীয়, যার সঙ্গে হৃদয়ের কথা ভাগ করা যায়।
৩. সন্তুষ্টি অর্জন: জীবনে সুখী হওয়ার জন্য আমাদের কিছু পেতে হবে এমন মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। আমাদের আশেপাশের ছোট ছোট সুখের বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। জীবন থেকে কিছুটা পরিতৃপ্তি এবং সাধারিতায় আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
৪. মৃত্যুর ভাবনা: মৃত্যুর চিন্তা আসলে আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ দেয়। একদিন সবাই চলে যাবে, কিন্তু আমরা কীভাবে বাঁচব, তা আমাদের হাতে। মৃত্যুর ভাবনা আমাদের জীবনের সঠিকতা বোঝায়—এটি আমাদের মৃত্যুর আগেই শিখিয়ে দেয় কীভাবে শান্তিতে বাঁচা যায়, কীভাবে সম্পর্কগুলো গড়ে তোলা যায় এবং কীভাবে আমাদের সত্যিকার আত্মবিশ্বাস অর্জন করা যায়।
৫. মনের শান্তি: অবশেষে, সবারই প্রয়োজন মনের শান্তি। শুধুমাত্র আমাদের দুঃখ-কষ্ট, জীবনযুদ্ধের মধ্যে থেমে না থেকে আমরা যদি অন্তরের শান্তি খুঁজে পাই, তবে কোনো কিছুই আমাদের দুঃখ দিতে পারবে না।
এই পৃথিবীতে সব কিছুই তাত্ক্ষণিক এবং অস্থায়ী, কিন্তু আমাদের চেতনা, আমাদের মনের শান্তি, আমাদের আধ্যাত্মিকতা একমাত্র স্থায়ী। আমাদের ভুলের পর ভুল, ক্ষতি আর বিচ্ছেদ সবকিছু নিয়েই একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু যদি আমরা জীবনে কিছুটা সততা, কিছুটা ভালোবাসা, কিছুটা শান্তি খুঁজে পেতে পারি, তবে আমাদের বিদায়টা হবে শান্তিপূর্ণ। মৃত্যুই একমাত্র সত্য, তবে আমাদের জীবন যদি ভালোবাসা ও শান্তিতে পরিপূর্ণ থাকে, তবে মৃত্যু যে আসবে, সেটা আমাদের ভয় নয়, একান্ত পরিণতি হিসেবে গ্রহণ করা যাবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com