অশ্রুভেজা চোখের চাহনির সেই দিনের স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সংগীত শিল্পী ফরিদা করিম গানটি পরিবেশন করেন। তিনি তাঁর কণ্ঠে সেই ঐতিহাসিক কাহিনি তুলে ধরেন, যেদিন কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজ হাতে রচিত এই গানটি শুনে গভীর আবেগে অশ্রুসজল হয়েছিলেন। গানটির মর্মকথাও তিনি তুলে ধরেন—এক গভীর আর্তি, যা বিদায় ও বেদনার প্রতিধ্বনি হয়ে যুগে যুগে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গান "আমার যাওয়ার সময় হলো আমায় দাও বিদায়"-এ যেন নিজের জীবনের বেদনাবিধুর অধ্যায়গুলোকে তুলে ধরেছিলেন। সৃষ্টির আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্লান্তি, অগণিত সংগ্রামের ভার, এবং পৃথিবীর নিরন্তর বিষাদ তাঁকে ভেতরে ভেতরে গ্রাস করছিল। তিনি অনুভব করেছিলেন, সময় এসেছে বিদায় নেওয়ার। এই পৃথিবী, যা তাঁকে শোষণ করেছে, ভালবেসেছে, আবার ভুলেও গেছে, সেই পৃথিবীকে ছেড়ে যাওয়ার আকুতি তাঁর সুরে প্রতিফলিত হয়েছিল।
তাঁর কণ্ঠে ছিল এক গভীর আর্তি—একাধারে বিদায়ের ব্যথা ও আত্মশুদ্ধির তৃষ্ণা। এটি ছিল কবির অন্তরের গহীন বেদনার মূর্ত প্রকাশ, যা আজও হৃদয়ে আঘাত হানে। ১৯৭২ সালের এক অবিস্মরণীয় দিন। স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যস্নাত বাংলাদেশ তখন সবে জেগে উঠেছে নতুন এক স্বপ্ন নিয়ে। সেই সময়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার মাটিতে ফিরে এলেন। বাঙালির আত্মার কবি, যিনি তাঁর শব্দে-সুরে যুগে যুগে জাগিয়ে তুলেছেন অগ্নিবীণার মর্মরধ্বনি। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডের ৩৩০ নম্বর কবি ভবন সেদিন পরিণত হয়েছিল এক অনন্য মিলনমেলায়। যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল আবেগ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এক অদৃশ্য সুর।
সেই দিনে, তরুণী ফরিদা করিম—যিনি ছিলেন এক টকটকে সুন্দরী এবং প্রতিভাময় নজরুল সংগীতশিল্পী—কবির সামনে পরিবেশন করলেন তাঁর অমর সৃষ্টি "আমার যাওয়ার সময় হলো আমায় দাও বিদায়"। গানটি শুরু হতেই চারপাশ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রতিটি সুর আর শব্দ কবির সৃষ্টির গভীরতম যন্ত্রণার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। গানটি শেষ হওয়ার পর সবাই দেখল, কবির চোখে টলটল করছে অশ্রু। কোনো শব্দ না হলেও, তাঁর সেই অশ্রুভেজা দৃষ্টি প্রকাশ করছিল এক গভীর অনুভূতি। সেই চোখের ভাষায় ছিল জীবনের ক্লান্তি, সৃষ্টির গৌরব, আর সুরের মায়া। গানটির প্রতিটি শব্দ যেন কবির আত্মার আর্তি হয়ে উঠেছিল। ফরিদা করিমের সেই পরিবেশনা ছিল কবির প্রতি তাঁর নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাঁর কণ্ঠে গাওয়া এই গান কবির জীবনের সুর, বেদনা এবং বিদায়ের এক অনন্য প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছিল। সেদিনের সেই আবেগঘন মুহূর্ত আজও নজরুলপ্রেমীদের হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে রয়েছে।
২০২৫ সালের ২৮ জানুয়ারির সন্ধ্যায় জাতীয় কবি নজরুল মঞ্চে আয়োজিত এক স্মরণসভায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতি বাবুল কাজীকে স্মরণ করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে নজরুল সংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী এবং জাতীয় কবি নজরুল মঞ্চের সভাপতি ফরিদা করিম পরিবেশন করেন সেই ঐতিহাসিক গান, "আমার যাওয়ার সময় হলো আমায় দাও বিদায়"। গানটি গাইবার সময় ফরিদা করিমের কণ্ঠে ছিল আবেগের অনুরণন, আর শ্রোতাদের চোখে ফুটে উঠেছিল সেদিনের সেই স্মৃতিময় মুহূর্তের চিত্র। ফরিদা করিমের পরিবেশনায় সুরের প্রতিটি শব্দ যেন হয়ে উঠল কবির আত্মার আর্তি। কবির সেই অশ্রুভেজা দৃষ্টি যেন আবারও ফিরে এলো স্মৃতির ঝাপটায়।
এই গান আজও কবির প্রতি বাঙালির অকৃত্রিম ভালোবাসার চিরন্তন সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে। বাবুল কাজীর স্মরণে এই পরিবেশনা কবির সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক অনন্য প্রতীক হয়ে রইল।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও সাধারণ সম্পাদক জাতীয় কবি নজরুল মঞ্চ চট্টগ্রাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com