বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকট বিরাজ করছে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে জনগণকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকৃষ্ট করলেও ক্ষমতায় গিয়ে তাদের কার্যক্রমে সেই প্রতিশ্রুতির ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। জাতীয় সংকটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার বদলে বিভাজন আরও গভীর হয়। শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের কারণে দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ধাবিত হয়েছিল। আন্দোলনের মুখে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। তবু নতুন কোনো সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও জনগণ আশার পরিবর্তে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশের মধ্যে আদর্শচ্যুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনিয়ম ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ক্ষমতার নামে অপকর্মের বিস্তার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দলের নীতিনির্ধারকরাও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তি যেন হুমকির মুখে।
এমন সংকটময় সময়ে জনগণের আশার একমাত্র আলো হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে সেনাবাহিনী সবসময়ই দেশের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করে এসেছে। দুর্যোগ মোকাবিলা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় সংকটে তাদের ভূমিকা অতুলনীয়। সেনাবাহিনীর সাহসিকতা, শৃঙ্খলা এবং আত্মত্যাগের প্রতি দেশের মানুষ চিরকাল কৃতজ্ঞ। এখন সময় এসেছে সেনাবাহিনীকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার, দুর্নীতি দমন এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে তাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সেনাবাহিনীকে তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মানুষ বিশ্বাস করে, সেনাবাহিনীর শক্তিশালী নেতৃত্বই কেবল দেশের অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর সক্রিয় পদক্ষেপ সময়ের এক অমোঘ দাবি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু একটি সামরিক শক্তি নয়; বরং এটি জাতির আস্থা, সাহস এবং সেবার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। স্বাধীনতার মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে সেনাবাহিনী তাদের সেবামূলক এবং দেশপ্রেমিক ভূমিকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের অবদান শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক উন্নয়ন, দুর্যোগ মোকাবিলা, এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও অসামান্য। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস, মানবিক দায়িত্ববোধ, এবং মানুষের সেবায় তাদের অসাধারণ ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা হবে। তারা কেবল দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়; বরং মানবতার সেবায় অঙ্গীকারবদ্ধ এক প্রতিষ্ঠান, যারা দেশের প্রতিটি সঙ্কটময় মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জাতির প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং গৌরবময় ইতিহাস- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সূচনা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও নির্মমতার বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় এ বাহিনীর জন্ম। তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ ও কৌশলে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলেন। তাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সেনাবাহিনী কেবল শত্রু দমনে নয়, বরং গণমানুষের আস্থা ও সাহসের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। তাদের নেতৃত্বে সারা দেশ জেগে উঠেছিল স্বাধীনতার ডাক নিয়ে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্য দিয়েই সেনাবাহিনীর গৌরবময় ইতিহাসের ভিত্তি রচিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সীমান্ত রক্ষা, এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারা নিরলস পরিশ্রম করেছে। মানুষের সেবায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দিক হলো, তারা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বরং দুর্যোগ, সঙ্কট এবং জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদন করে। দুর্যোগ মোকাবিলা- বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস এবং নদীভাঙন—প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা অপরিসীম। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় “মোখা”-র সময় সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বন্যায় আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ, এবং পুনর্বাসনে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা দিনের পর দিন দুর্গম এলাকায় কাজ করেছেন, যেখানে অন্যান্য সংস্থা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অবদান-
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করা। পদ্মা সেতু নির্মাণ, কর্ণফুলী টানেল, এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উন্নয়নসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান দেশের উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
এছাড়া সড়ক নির্মাণ, ব্রিজ তৈরি, এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নে সেনাবাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণ মানুষকে উন্নত জীবনের সুযোগ এনে দিয়েছে। তাদের পেশাদারিত্ব এবং সততার কারণে এই প্রকল্পগুলো দ্রুত এবং সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভূমিকা- সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান প্রশংসনীয়। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল পরিচালনা করে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর পরিচালিত সিএমএইচ (কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতাল) দেশের অন্যতম সেরা চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজসহ অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজও চিকিৎসা খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় ভূমিকা- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সন্ত্রাসবাদ দমন, চোরাচালান প্রতিরোধ, এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার মতো জটিল কাজগুলো সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে। ১৯৯০-এর দশকে সন্ত্রাসবাদ দমনে পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ এবং পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা আজও মানুষের মনে আস্থা জাগায়। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরেকটি গৌরবময় অধ্যায় হলো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অবদান। ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে আত্মপ্রকাশ করে। সেই থেকে তারা বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে আসছে। বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় হাজার হাজার সদস্য কর্মরত। কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে তারা সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের দক্ষতা, সাহসিকতা এবং মানবিক কাজ বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অবদান শুধু দেশের গৌরবই বাড়ায়নি; বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকেও শক্তিশালী করেছে।
নারীদের অংশগ্রহণ- বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক মিশনেও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি নারী সেনাসদস্যদের উপস্থিতি নারী ক্ষমতায়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
এছাড়া চিকিৎসা, প্রশাসন, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সেনাবাহিনীর কর্মক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে।সেনাবাহিনী: আস্থার প্রতীক- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে সবসময়ই এগিয়ে। তাদের কর্তব্যপরায়ণতা, সাহসিকতা, এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আরও দৃঢ় করেছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অস্থিরতা—প্রতিটি সঙ্কটময় সময়ে সেনাবাহিনীর নির্ভরযোগ্য ভূমিকা প্রমাণ করে যে, তারা কেবল দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়; বরং জনগণের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের গৌরবময় ইতিহাস, মানবিক সেবা, এবং দেশের উন্নয়নে অবদান আমাদের জন্য এক অনন্য প্রেরণা।
সেনাবাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টা, আত্মত্যাগ, এবং দেশপ্রেম জাতির জন্য এক অসাধারণ উদাহরণ। তারা শুধু আমাদের দেশের নিরাপত্তার রক্ষক নয়, বরং উন্নয়ন ও মানবতার সেবায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আমাদের দায়িত্ব হলো সেনাবাহিনীর এই সেবামূলক ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এই দেশপ্রেমিক বাহিনী জাতির জন্য যে আত্মত্যাগ করে চলেছে, তা চিরকাল আমাদের হৃদয়ে জায়গা করে থাকবে।
লেখকঃ যুগ্ম সম্পাদক-দৈনিক ভোরের আওয়াজ ওThe Daily banner, গবেষক, এবং টেলিভিশন উপস্থাপক।