আমি একজন নগণ্য সমাজকর্মী, আমি ১৯৮৮ সাল থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে রয়েছি। পাশাপাশি, আমি চেষ্টা করেছি এই মহান মানুষদের, যারা সমাজের জন্য অবদান রেখেছেন, তাদেরকে সম্মান জানাতে। আমার এই সংগ্রামের পেছনে তাদের গৌরবময় ইতিহাসই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমি একজন সংগ্রামী, যেমনটি আমি চিহ্নিত করতে চাই, তেমনি লেখালেখির মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় থেকে এই মহান ব্যক্তিদের তুলে আনার চেষ্টা করছি।
আজকের দিনে, আমি এই মহান পুরুষ আবদুল লতিফ উকিলের কিছু কথা তুলে ধরতে চেয়েছি। তার সুযোগ্য সন্তান, সাংবাদিক মাঈনউদ্দিন কাদেরী শওকত ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ তিন দশক ধরে আমার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। শওকত ভাইয়ের সাথে এই সম্পর্কের মাধ্যমে আমি তার পিতার জীবন ও সংগ্রামের অনেক কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি। শওকত ভাই আমাদের বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তার অমূল্য অবদান ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এস এম জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের উন্নয়নে যে সংগ্রাম চলেছিল, তাতে শওকত ভাইয়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজ, আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার পিতার অবদান স্মরণ করে এই লেখাটি লিখছি। এটি শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নয়, বরং একটি আন্তরিক আহ্বান, যাতে আমাদের নতুন প্রজন্ম এই মহান নেতাদের জীবনের মূল কথা জানতে পারে এবং তাদের শিখতে পারে। তাদের সংগ্রাম, তাদের কাজ, তাদের ভাবনা – এসবই আমাদের পথ প্রদর্শক। এর মাধ্যমেই আমরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক, সৎ, এবং সংগ্রামী মানুষ হয়ে উঠতে পারব। এভাবে আমি আবদুল লতিফ উকিলের জীবনকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং তার পুত্র শওকত ভাইয়ের মাধ্যমে সেই ইতিহাসের আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত রাখার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক মহান নেতার নাম উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। তবে কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব এমন আছেন, যাদের কাজ, সংগ্রাম এবং অবদান অনন্তকালের জন্য চিরকাল মনে রাখার মতো হয়ে থাকে। আবদুল লতিফ উকিল ছিলেন এমন একজন মহান নেতা, যিনি তার জীবনদর্শন, সমাজ সংস্কার, রাজনীতির প্রতি গভীর অবদান এবং দেশের প্রতি নিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসে নিজেদের অমর জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁর জীবন কেবল ব্যক্তিগত সংগ্রামের গল্প নয়, বরং তা ছিল একটি জাতির উন্নতির ও সামাজিক সুবিচারের লড়াই।
আব্দুল লতিফ উকিলের জীবনযাত্রা ছিল এক অনন্য সংগ্রাম ও আদর্শের পথচলা, যেখানে তিনি একদিকে ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ এবং অন্যদিকে ছিলেন একজন অগ্রসর চিন্তক, যিনি দেশের উন্নয়ন এবং সমাজের কল্যাণে তার অনুপ্রেরণামূলক ভূমিকা রেখেছেন। ২০ জানুয়ারি ১৯৬৫, যখন তিনি প্রয়াত হন, তখন তিনি মাত্র ৬৯ বছর বয়সী ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রভাব এবং উত্তরাধিকার আজও আমাদের মাঝে জীবিত। আজ তাঁর ৬০ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে, আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করি এই মহান ব্যক্তিত্বকে, যিনি চট্টগ্রামের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দ্যুতি ছড়িয়ে গেছেন।
জন্ম ও শৈশবঃ আব্দুল লতিফ উকিল ১৮৯৫ সালের ১ মার্চ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম এমন একটি সময়ে, যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিকার ছিল এবং মানুষের মাঝে স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। তার পরিবারের মধ্যে ছিলেন আইনের সঙ্গে যুক্ত সদস্যরা। তাঁর বাবা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, যিনি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। পরবর্তীকালে আবদুল লতিফ উকিল তাঁর পরিবারসহ ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। চট্টগ্রামের ভূমিতেই তিনি তার শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন, এবং এখানকার পরিবেশেই তার শৈল্পিক ও রাজনৈতিক জাগরণের প্রাথমিক সূচনা হয়।
শিক্ষার ক্ষেত্রে আবদুল লতিফ উকিল ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী এবং প্রতিভাশালী ছাত্র। তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন এবং সেখানে তাঁর মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যেই তিনি বোধ করেছিলেন যে, দেশের স্বাধীনতার জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন অপরিহার্য। সেই থেকেই তাঁর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আইনি সংগ্রাম শুরু হয়।
আইনজীবী হিসেবে যাত্রা
আব্দুল লতিফ উকিলের আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল তার তরুণ বয়সেই। তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে
পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি আইন পেশায় যুক্ত হন এবং খুব দ্রুতই তিনি চট্টগ্রামের একজন প্রধান আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং পাশাপাশি চট্টগ্রাম আইন কলেজের সাংগঠনিক কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তার আইনজীবী জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করেন, যেখানে তার দক্ষতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতি তাকে সমাজে বিশেষভাবে শ্রদ্ধিত করে তোলে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান আব্দুল লতিফ উকিল ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের চট্টগ্রাম শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক (১৯২৪)। তখন তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে শুরু করেন। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কেবল ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেননি, বরং তিনি সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন এবং তাদের জন্য ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক সংস্কারের পথে
আব্দুল লতিফ উকিলের জীবন ছিল এক বহুমুখী সংগ্রাম, যেখানে তিনি শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং সমাজ সংস্কারেও তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তিনি হাটহাজারী হাই স্কুল, কাজেম আলী হাই স্কুল, গুলজার বেগম গার্লস হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভর্ণিং বডির সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি শিক্ষা, সমাজ সংস্কার এবং নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করার জন্যও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল সামাজিক অসাম্য দূর করার প্রচেষ্টা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন দরগাহ কমিটির সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তার পেছনে যে সামাজিক পরিবর্তনের আদর্শ ছিল তা ছিল একজন সমাজ সংস্কারক এবং ন্যায়বিচারের প্রতি নিষ্ঠার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নেতৃত্বের দৃঢ়তা
আব্দুল লতিফ উকিলের নেতৃত্বের দৃঢ়তা ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি তৃণমূল থেকে উঠে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের উন্নয়নে নিজের অবদান রেখেছেন। তিনি হাটহাজারী ইউনিয়ন বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ইউনিয়ন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বের মধ্যে ছিল জনকল্যাণমূলক চিন্তা, যা তাকে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী স্থান করে দিয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম পোস্টাল ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং চট্টগ্রামের উন্নয়ন কাজে সর্বদা অংশগ্রহণ করেছেন।
আন্তর্জাতিক সম্মান-
আব্দুল লতিফ উকিলের কর্মজীবনে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাঁকে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। তিনি ভারতীয় আইন সভার সদস্য ছিলেন এবং অল ইন্ডিয়া বার কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের আইন প্রথার উন্নয়নে কাজ করেছিলেন। তাঁর আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বজুড়ে প্রশংসা ছিল এবং বিভিন্ন দেশের আইনজীবী সমাজ তাকে সম্মানিত করেছিল।
তাঁর পরিবার ও উত্তরাধিকার
আব্দুল লতিফ উকিল ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, যার পরিবারের প্রতিটি সদস্যই তার আদর্শ অনুসরণ করে সফল হয়েছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত নিউরোসার্জন ডা. এল এ কাদেরী এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রখ্যাত সাংবাদিক মাঈনুল কাদেরী শওকতের প্রিয় পিতা। তার সন্তানরা তাঁর আদর্শকে ধারণ করে বাংলাদেশে নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার পরিবারের সদস্যরা দেশে এবং বিদেশে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং আবদুল লতিফ উকিলের কর্মের ধারা বজায় রাখছেন।
মৃত্যুর পরও অবদান- ১৯৬৫ সালের ২০ জানুয়ারি আবদুল লতিফ উকিল আমাদের ছেড়ে চলে যান, কিন্তু তার অবদান চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। তার কাজ, সংগ্রাম, আদর্শ এবং মানবিক মূল্যবোধ আমাদের প্রেরণা যুগিয়ে যাবে। তার আদর্শ এবং সংগ্রাম আমাদেরকে শেখায় যে, এক ব্যক্তির জীবন কিভাবে পুরো সমাজের উন্নতির জন্য নিবেদিত হতে পারে। আজ, তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করছি এবং তার আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি।
আব্দুল লতিফ উকিল ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক, এক উন্নয়ন কর্মী, এক আদর্শিক নেতা। তাঁর অবদান চিরকাল বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে থাকবে
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com