সুচিত্রা সেন: এক মহীয়সী মহানায়িকার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি- লেখাটি লিখলাম-পাবনার রমা দাশগুপ্ত, যিনি বিশ্ববাসীর কাছে সুচিত্রা সেন নামে পরিচিত—বাংলা চলচ্চিত্রের এক অমর অধ্যায়। তাঁর নাম জানে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাংলা সিনেমার মহানায়িকা হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতা, যা আজও অমলিন। যদিও তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি, তাঁর কালজয়ী অভিনয় এখনো আমাদের হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছে।
আশির দশকে যখন নতুন নতুন ভিডিও সেট বাজারে আসছিল, তখন ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু সে সময় সিনেমা দেখা ছিল সহজ বিষয় নয়। ভিডিও সেট কেনা এবং চালানো ছিল প্রায় নিষিদ্ধের মতো। গোপনে বিক্রি হতো, গোপনে দেখানো হতো। বিশেষ করে বিয়েবাড়ি গুলোতে রাতে ভিডিও সেটে সিনেমা চালানো হতো, আর আমরা দল বেঁধে সেখানে ছুটে যেতাম। যদিও পুলিশের ভয় ছিল, তবুও সেই আনন্দের মুহূর্তগুলো ছিল অমূল্য।
সেই সময়ের ভিডিও সেটগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা হতো উত্তম-সুচিত্রার কালজয়ী সিনেমাগুলো। উত্তম কুমার ছিলেন মহানায়ক, আর সুচিত্রা সেন ছিলেন অনন্য মহা-নায়িকা। তাঁদের রসায়ন, তাঁদের প্রেম, তাঁদের সংলাপ বাঙালি দর্শকদের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে গিয়েছিল। আজও সেই সিনেমা গুলো ইতিহাস হয়ে আছে, যা আমরা ভুলতে পারি না।
গতকাল, ১৭ জানুয়ারি, ছিল সুচিত্রা সেনের প্রয়াণ দিবস। অথচ কোথাও তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান চোখে পড়েনি। আগে চ্যানেল আই সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তাঁকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন হতো, তাঁর সিনেমার প্রদর্শনী হতো, স্মৃতিচারণ করা হতো। কিন্তু এবার তেমন কিছুই হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কি তবে তাঁকে ভুলে যাচ্ছি? আমি সুচিত্রা সেনকে নিয়ে বহুবার লিখেছি, তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে বহুবার কলম ধরেছি। আজ আবারও সেই শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুচিত্রা সেন কেবল একজন নায়িকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক অনুভূতি, এক আবেগ, এক ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। যতদিন বাংলা চলচ্চিত্র থাকবে, যতদিন বাঙালির হৃদয়ে সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থাকবে, ততদিন সুচিত্রা সেনের নাম অমর হয়ে থাকবে। ১৭ই জানুয়ারি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের ১১তম প্রয়াণ দিবস। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি, কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ফুসফুসের জটিলতায় ভুগে, শেষপর্যন্ত চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া এই মহানায়িকা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। তবে তার বিদায় শুধু শারীরিক উপস্থিতির—তিনি আজও জীবন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে, তিনি আজও বেঁচে আছেন তার অসংখ্য অনবদ্য সিনেমায়, বাংলা সিনেমার অনুরাগীদের হৃদয়ে। সুচিত্রা সেন শুধুমাত্র একজন নায়িকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একটি স্বর্ণযুগ, একটি অধ্যায়। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন রোমান্টিক সিনেমার অপরিহার্য মুখ। তার নাম উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উত্তম কুমারের সঙ্গে তার রোমান্টিক জুটি। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ এই জুটির প্রেম ও আবেগে ভরা অভিনয় আজও দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
রমা থেকে সুচিত্রা: কিংবদন্তির জন্ম
সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল, বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। জন্মসূত্রে তার নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহিণী। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে রমা ছিলেন মেজো মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তার সৌন্দর্য ছিল নজরকাড়া। তার আত্মস্থ ও সংযত ব্যক্তিত্ব, গভীর দৃষ্টিভঙ্গি, অনন্য রূপ-লাবণ্য তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। ১৯৪৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় কলকাতার শিল্পপতি দিবানাথ সেনের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি হয়ে যান রমা সেন। দিবানাথ সেন ছিলেন একজন রুচিশীল মানুষ, যিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার স্ত্রী কেবল সৌন্দর্যেই অতুলনীয় নন, তার মাঝে অভিনয়েরও অসাধারণ প্রতিভা রয়েছে। তাই তিনি উৎসাহিত করেন রমাকে সিনেমায় অভিনয় করতে।
১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে সুচিত্রার সিনেমায় অভিষেক ঘটে, যদিও ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। তবে ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাত নম্বর কয়েদী’ ছিল তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। আর সেই বছরই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করে তিনি রাতারাতি তারকা বনে যান। তার অভিনয়ের মাধুর্য, সংলাপ বলার ভঙ্গি, আবেগময় দৃষ্টিভঙ্গি এবং সৌন্দর্য দর্শকের হৃদয় জয় করে নেয়। তখন থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার মহানায়িকা। উত্তম-সুচিত্রা: চিরস্মরণীয় জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উত্তম-সুচিত্রা জুটি এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘শাপমোচন’, ‘সাগরিকা’, ‘হারানো সুর’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘সপ্তপদী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘সাত পাকে বাঁধা’— একের পর এক অসাধারণ সিনেমায় তারা প্রেম, বেদনা ও ভালোবাসার মুগ্ধকর রসায়ন তৈরি করেছেন। উত্তম-সুচিত্রা যুগলবন্দি বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদার আসনে পৌঁছে দেয়।
তাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে নানান জল্পনা-কল্পনা থাকলেও, সুচিত্রা সেন কখনো কোনো বিষয়ে খোলাসা করেননি। তবে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর তিনি তার শেষকৃত্যে উপস্থিত হতে পারেননি, যা অনেকের কাছেই রহস্যের বিষয় হয়ে রয়ে গেছে।
হিন্দি সিনেমায় সুচিত্রা সেন শুধু বাংলা নয়, সুচিত্রা সেন বলিউডেও তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৫৫ সালে দিলীপ কুমারের সঙ্গে ‘দেবদাস’ ছবিতে পার্বতী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি জাতীয় স্বীকৃতি পান। এছাড়াও ‘বোম্বাই কা বাবু’, ‘মমতা’, ‘আঁধি’— এসব ছবিতে তার অভিনয় আজও প্রশংসিত। গোপন জীবনের রহস্য
১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রণয় পাশা’ ছিল সুচিত্রা সেনের শেষ ছবি। এরপর তিনি নিজেকে পুরোপুরি চলচ্চিত্র ও জনজীবন থেকে সরিয়ে নেন। কেন তিনি এমন স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন, তার কোনো সুস্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। বলা হয়, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় নিমগ্ন হয়ে তিনি সংসার ও চলচ্চিত্র থেকে দূরে চলে যান।
এই ৩৫ বছর তিনি সংবাদমাধ্যম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকেন। তার কোনো ছবি পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। এমনকি মৃত্যুর সময় তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার নির্দিষ্ট চিকিৎসক ও সেবিকা ব্যতীত অন্য কেউ যেন তাকে দেখতে না পারে। তার মেয়ে মুনমুন সেন মায়ের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাউকে সাক্ষাতের অনুমতি দেননি। সুচিত্রা সেন তার জীবনের শেষ অধ্যায়ে যেমন
নির্জনতা বেছে নিয়েছিলেন, মৃত্যুর সময়ও তেমনই নিভৃতে চলে গেলেন।
শেষ বিদায়
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সকালে তিনি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।
অমর হয়ে রইলেন মহানায়িকা
সুচিত্রা সেন আত্মজীবনী লেখেননি, কোনো সাংবাদিককেও তার জীবন নিয়ে লিখতে দেননি। তবে তার প্রতিটি সিনেমাই তার জীবনের গল্প বলে। বাংলা চলচ্চিত্রের এই চিরসবুজ নায়িকার অবদান কখনও বিস্মৃত হবে না। নতুন প্রজন্মের জন্য তার জীবনচরিত প্রকাশ করা জরুরি, যাতে তারা বুঝতে পারে— কেন তিনি ‘মহানায়িকা’।
আজও যখন আমরা পর্দায় ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউন, ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর করুণা, ‘সাত পাকে বাঁধা’র অরুন্ধতী কিংবা ‘দেবদাস’-এর পার্বতী চরিত্রে সুচিত্রাকে দেখি, তখন মনে হয় তিনি রূপালী পর্দার আকাশে চিরকাল জ্বলজ্বল করবেন।
আমরা, সুচিত্রা সেন-প্রেমীরা, তার আত্মার শান্তি কামনা করি। বাংলার রমা থেকে ভারতের সুচিত্রা— তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, এবং তিনি থাকবেন চিরদিন।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com