বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যার দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু পুলিশকে সবসময়ই ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। ব্রিটিশ শাসনামলে পুলিশ যেভাবে শাসকদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করেছিল, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। পুলিশ আজও ক্ষমতার পক্ষেই কাজ করে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিনকে হেনস্তার ঘটনা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁকে নগরের পাঁচলাইশের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে ঘেরাও করে লাঞ্ছিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, তাঁর পোশাক ধরে টানাটানি করা হচ্ছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
পুলিশ তুমি কার? ক্ষমতা যার, তার! বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুলিশের ভূমিকা বরাবরই বিতর্কিত। যে দল ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ তাদের স্বার্থে কাজ করে। ফলে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ভূমিকা পাল্টে যায়, কিন্তু তাদের কাজের ধরন একই থাকে। একসময় আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করেছেন ওসি নেজাম উদ্দিন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি বিএনপি কর্মীদের প্রতিশোধের শিকার হয়েছেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো, ওসি নেজামের দোষ কী? নেজাম উদ্দিন তাঁর দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতাসীনদের নির্দেশ পালন করেছেন। এটি ঠিক যেমন আজকের পুলিশ বর্তমান সরকারের পক্ষে কাজ করছে। তবে তাঁকে সন্তানদের সামনে শারীরিক ও মানসিক হেনস্তা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি শুধু একটি ব্যক্তিকে অপমান নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি অসম্মানও বটে।
কেন এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ
১. বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ:
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবসময় ন্যায়বিচারের কথা বলে এসেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ যা করেছে, তিনি ক্ষমতায় গেলে তা করবেন না। তাহলে তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের এই আচরণ কি তাঁর সেই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ?
২. রাজনৈতিক শিষ্টাচার:
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর বাসার কাছেই এই ঘটনা ঘটেছে। এটি রাজনীতির শিষ্টাচার ও মানবিকতার পরিপন্থী।
৩. আইনের শাসন:
যদি নেজাম উদ্দিন তাঁর দায়িত্ব পালনকালে অন্যায় করে থাকেন, তবে তা আইনের মাধ্যমে বিচার করা উচিত। হেনস্তা ও লাঞ্ছনা কোনো সুষ্ঠু বিচার হতে পারে না।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি ভাঙার সময় এসেছে
আমরা বারবার দেখি, ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হয়রানির শিকার হয়। এটি কোনো পক্ষের জন্যই স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। পুলিশকে ক্ষমতার লাঠিয়াল থেকে জনগণের প্রকৃত বন্ধুতে পরিণত করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আইন প্রয়োগের নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
ওসি নেজামের ঘটনা এবং তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ
এ ঘটনা বিএনপির নেতৃত্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারেক রহমানের প্রতি দেশের মানুষ আশা রাখে যে, তিনি একটি ন্যায়সংগত, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করবেন। এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমে তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
আমরা আশা করি, বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এই ঘটনার যথাযথ গুরুত্ব বুঝবেন এবং তারেক রহমান এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মোট জনবল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেনাবাহিনীতে প্রায় ১,৬০,০০০ জন সদস্য রয়েছে। নৌবাহিনীতে ২৫,২৮১ জন, বিমানবাহিনীতে ১৩,৬৯৪ জন এবং পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা ২,১২,৭২৪ জন।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবির জনবল ৬৭,০০০ জন, র্যাব বাহিনীতে ১২,০০০ জন, এবং জরুরি উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপণ কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের সদস্য সংখ্যা ১৩,৩১৬ জন। এছাড়া, দেশের কারাগার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা পুরুষ কারারক্ষীর সংখ্যা ৮,৫৬৫ জন, আর মহিলা কারারক্ষী রয়েছেন ৬১৭ জন। বাংলাদেশের এই বাহিনীগুলো দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ বাহিনীগুলোর সদস্যরা অতীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন বাহিনী গঠন করা সম্ভব নয়, কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিদ্যমান বাহিনীগুলোকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব বাহিনী রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করবে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যদি নিরপেক্ষ রাখা না হয় এবং দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা বাহিনীগুলোর জন্য যেমন কলঙ্কজনক, তেমনি জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার বানানোও অগ্রহণযোগ্য।
বচট্টগ্রামের সাবেক ওসি নেজাম উদ্দিনের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপি সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছে, যা দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ইতিবাচক। তবে, বিষয়টি আইনগতভাবে মীমাংসা করা প্রয়োজন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে সমানভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে। পুনরায় বলতে হয়, পুলিশ বা অন্য বাহিনী জনগণের নয়, বরং ক্ষমতার। কিন্তু সেই পুলিশ বাহিনীকে সত্যিকার অর্থে জনগণের বাহিনীতে পরিণত করাই রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে জরুরি।
— দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily Banner-এর যুগ্ম সম্পাদক।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com