একটি প্রতীক্ষার নাম: শীতের সূর্য
রাতভর হাড় কাঁপানো শীত। শরীরটা যেন জমে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এক টুকরো বরফ হয়ে গেছি। আগুনের শিখা নিভে গেছে, কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। রাস্তার পাশে বসে থাকা সেই বৃদ্ধ মানুষটি কাঁপছে, তার গায়ে নেই কোনো কম্বল, নেই কোনো উষ্ণতার আশ্রয়। এই শীতের রাতে তার একমাত্র আশ্রয় খোলা আকাশ, একমাত্র সঙ্গী কুয়াশা আর হিমেল বাতাস। একটুখানি উষ্ণতার জন্য তাকিয়ে আছে পূর্বাকাশের দিকে, সূর্য উঠবে, তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেবে, আর কিছুক্ষণ পর তার শরীরের অসহনীয় ঠান্ডা হয়তো একটু কমবে।
“হে সূর্য! তুমি তো জানো, আমাদের কত অভাব!
তুমি না থাকলে এই শীতে আমরা কীভাবে বাঁচতাম?”
কিন্তু সূর্য তো বুঝতে পারে না! বুঝতে পারলেও সে তো কেবল আলো দিতে পারে, উষ্ণতা দিতে পারে, কিন্তু কাপড় দিতে পারে না, খাবার দিতে পারে না, আশ্রয় দিতে পারে না। এসবের দায়িত্ব তো মানুষের, সমাজের, রাষ্ট্রের! গোলাপি আর খেলাপি: দুটি সমাজের গল্প আমাদের সমাজ দুটি ভাগে বিভক্ত— গোলাপি আর খেলাপি। গোলাপিরা শীত উপভোগ করে। তারা শীতের বিকেলে উষ্ণ কফি পান করে, শীতের রাতে নরম লেপ-কম্বলের নিচে আরাম করে। তাদের বাসার জানালা বন্ধ, শীত যেন কক্ষের ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে। তারা পাজেরো গাড়িতে চড়ে, উন্নত হোটেলে যায়, দামি শীতবস্ত্র পরে, আর বলে— “শীত তো দারুণ উপভোগের ঋতু!” কিন্তু খেলাপিরা? তারা পায়ের জোরে চলে, ফুটপাতে বা গাছতলায় রাত কাটায়। তাদের কোনো উষ্ণ কক্ষ নেই, কোনো লেপ-কম্বল নেই, তাদের কাছে শীত মানে এক দুঃসহ যন্ত্রণা। গোলাপিরা বিলাসিতার মাঝে থাকে, আর খেলাপিরা শীতের নির্মম বাস্তবতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, রাষ্ট্র সবসময় গোলাপিদের পাশে থাকে, খেলাপিদের কথা শোনারও সময় নেই। সংবিধানের কথা, বাস্তবতার চিত্র আমাদের সংবিধান বলছে— “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ”(অনুচ্ছেদ ৭(১)“অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার” (অনুচ্ছেদ ১৫(ক) “সমাজের সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব” (অনুচ্ছেদ ১৯(১)) কিন্তু এই সংবিধানের কথাগুলো শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। শীতের রাতে যে শিশুটি একটুখানি গরম কাপড়ের জন্য কান্না করছে, যে বৃদ্ধার শীতের কারণে শরীর কাঁপছে, যে রিকশাচালক পাতলা শার্ট গায়ে দিয়ে শীতের হিমেল বাতাসে যাত্রী টানছে—সংবিধানের পাতায় লেখা কথাগুলো তাদের কোনো কাজে আসে না। কেন? কারণ সংবিধান কেবল ক্ষমতাবানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়, গরিব-অসহায়দের অধিকার রক্ষার জন্য নয়। শীতবস্ত্র বিতরণ: লোক দেখানো সহায়তা প্রতিবছর আমরা দেখি, কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিংবা রাজনৈতিক নেতা শীতবস্ত্র বিতরণ করে। কিন্তু সেটাও লোক দেখানো। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে শীতার্তদের হাতে কম্বল তুলে দেওয়া হয়, মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, যেন তারা খুব বড় কিছু দান করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো— যে মানুষটির সত্যিকারের শীতবস্ত্র দরকার, সে হয়তো সেই সহায়তা পাচ্ছে না। বিতরণ করা কাপড়ের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। অনেক সময় কম্বল বিতরণ হয় দলের কর্মীদের মধ্যে, প্রকৃত দুঃস্থ মানুষের হাতে পৌঁছায় না। শীত কি কেবল মিডিয়ার সামনে ছবি তোলার বিষয়? শীত কি কেবল লোক দেখানো সাহায্য বিতরণের সুযোগ? শীতার্ত মানুষের অনিশ্চিত জীবন এই শীতে কত মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, কত শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়, কত বৃদ্ধা এই ঠান্ডায় ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়—এসবের কোনো হিসাব কি আমরা রাখি? শীতের কারণে— হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। দিনমজুরদের কাজ কমে যায়, কারণ সকালে কুয়াশা, রাতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের সংকটে পড়ে। ফুটপাত, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনালের মতো জায়গায় রাত কাটানো মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। এই মানুষগুলোর জন্য কি কেউ কিছু করবে না? সংবিধান কি শুধু ধনী, ক্ষমতাবানদের জন্য? মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে কবে? আমাদের সমাজে যারা সচ্ছল, তারা যদি একটু এগিয়ে আসে, তাহলে এই শীতার্ত মানুষদের কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। শীতের কষ্ট কোনো রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় নয়, এটি মানবতার বিষয়। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে কবে? আমরা কি শুধুই মিডিয়ায় দেখে, দুদিন আফসোস করে ভুলে যাবো? আমরা কি শুধুই রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাস শুনবো? আমরা কি আমাদের সামান্য সামর্থ্য দিয়েও শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে পারবো না?
একটি উষ্ণ কাপড় হয়তো কারো জীবন বাঁচাতে পারে। একটি কম্বল হয়তো কারো রাতের নিদ্রা ফিরিয়ে দিতে পারে। আসুন, আমরা আমাদের চারপাশের দরিদ্র, শীতার্ত মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে আসি। কারণ সূর্য একা এই শীতের কষ্ট কাটাতে পারবে না—আমাদের সাহায্যের হাত দরকার। মানুষের জন্য মানুষ, এটাই তো মানবতার সবচেয়ে বড় শিক্ষা!
এখানে প্রশ্ন থাকে-সমাজের সত্যিকারের দায়িত্বশীলতা কোথায়? শীত এলেই দেখা যায়, ফেসবুক ভরে যায় শীতবস্ত্র বিতরণের ছবিতে। কিছু মানুষ কম্বল হাতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছেন, যেন এটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। অথচ শীতের রাতে যখন প্রকৃত দুস্থরা ফুটপাথে কাঁপতে থাকে, তখন অনেক বিত্তবান তাঁদের আরামের বিছানায় নিশ্চিন্ত ঘুমে মগ্ন থাকেন। শীতবস্ত্র বিতরণ লোক দেখানোর জন্য নয়, এটি একটি মানবিক দায়িত্ব। যারা প্রকৃত শীতার্ত, যারা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়, তাদের হাতে যেন সঠিকভাবে সহায়তা পৌঁছে—এটাই হওয়া উচিত প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, অনেক স্বচ্ছল মানুষও কম্বল নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে যান, কেবলমাত্র ফ্রি কিছু পাওয়ার লোভে। আর সেই মুহূর্তগুলোকেও অনেকে ক্যামেরাবন্দি করে প্রচারের খোরাক বানান। মানবতা কি সত্যিই এতটাই সস্তা হয়ে গেছে? যদি সত্যিই সাহায্য করতে চান, তাহলে লোক দেখানো ছবি পোস্ট না করে নিরবে, আন্তরিকভাবে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ান। আপনার একটি কম্বল হয়তো কারও জন্য বেঁচে থাকার সম্বল হতে পারে। আসুন, শীতকে দয়ার বস্তু না বানিয়ে, বরং সহমর্মিতার মাধ্যমে সত্যিকারের মানুষের পরিচয় দেই।