স্মৃতির আকাশে কিছু মুহূর্ত ঝলমলে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে, সময়ের দীর্ঘ স্রোতও তাদের মুছে ফেলতে পারে না। আমার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতার কথা যখনই মনে পড়ে, তখনই মনে হয়—এ যেন রূপকথার এক অধ্যায়, যেখানে বাস্তবতা আর স্বপ্ন এক বিন্দুতে মিশে গিয়েছিল। সাহিত্যিকদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি, তাদের জীবন যেন এক রহস্যময় উপাখ্যান, তাদের ভাবনার গভীরতা যেন এক মহাসমুদ্র। আর যদি সেই সাহিত্যিক হন জ্যঁ-মারি গাস্তঁ লে ক্লেজিও, ২০০৮ সালের নোবেলজয়ী ফরাসি কথাসাহিত্যিক, তাহলে তো সে অভিজ্ঞতা কল্পনারও অতীত!
সেই অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা এসেছিল ২০১২ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব লেখক সম্মেলনে। আমার মতো একজন সাধারণ লেখক ও সাংবাদিক কীভাবে এক নোবেলজয়ীর সংস্পর্শে এলাম—এ এক বিস্ময়কর কাহিনি, যা আজও আমাকে ভাবায়। সপ্তাহব্যাপী প্রতীক্ষা
গুয়াংজু শহর যেন সাহিত্যিকদের এক মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল তখন। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে খ্যাতনামা কবি, কথাসাহিত্যিক, দার্শনিকেরা এসেছিলেন সেখানে, আর আমি ছিলাম তাদের মাঝখানে এক ক্ষুদ্র সত্তা, বিস্ময়াবিষ্ট এক পর্যটকের মতো। আমি জানতাম, লে ক্লেজিও এসেছেন। তাকে দূর থেকে দেখেছি, শুনেছি তার কথাবার্তা, অনুভব করেছি তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মাধুর্য। কিন্তু তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলার, তাকে কাছ থেকে জানার সুযোগ আসবে কি না, তা জানতাম না। পুরো সপ্তাহ কেটে যাচ্ছিল নানা আলোচনার মাঝে। আমি একরকম আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের লেখনী কখন কোথায় বাঁক নেয়, তা তো কেউ জানে না! চায়ের টেবিলে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক! সন্ধ্যার এক নিস্তব্ধ মুহূর্ত, গুয়াংজুর হুন্দাই হোটেলের লবি। গরম চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিলাম, তখনও ভাবনার জগতে ডুবে ছিলাম। এমন সময়, সামনে এসে দাঁড়ালেন লে ক্লেজিও! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। তিনি মৃদু হাসলেন, এক হাত তুলে জানালেন শুভেচ্ছা। তারপর হঠাৎ করেই পাশে বসে পড়লেন। — "তুমি কোন দেশ থেকে?" তার কণ্ঠে ছিল এক অপূর্ব মাধুর্য, যেন কোনো সুরেলা যন্ত্রের মৃদু বাজনা। — "বাংলাদেশ!" শব্দটা শুনেই তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। "বাংলাদেশ! আহা! তোমাদের ভাষার জন্য যে সংগ্রাম, তা তো ইতিহাসের অংশ!" আমার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। তিনি জানেন আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা! শুধু তাই নয়, একে একে বললেন আমাদের অনেক সাহিত্যিকের নাম, বললেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, হুমায়ুন আহমেদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ—এ যেন এক বিস্ময়ের পর বিস্ময়! আমি ভাবছিলাম, একজন ফরাসি সাহিত্যিক, যিনি ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন, কীভাবে এত গভীরভাবে আমাদের সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কে জানেন?
তিনি নিজেই উত্তর দিলেন, — "সাহিত্যের কোনো সীমা নেই, জানো তো? ভাষা, দেশ, সংস্কৃতি আমাদের দূরে রাখতে পারে না। আমি বাংলার সাহিত্য পড়েছি, তোমাদের সংগ্রামের কথা জেনেছি। তোমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়!" তার প্রতিটি শব্দ যেন আমার হৃদয়ে একেকটি শিহরণ জাগাচ্ছিল। নোবেলজয়ীর হাতে চায়ের কাপ কথার মাঝে হঠাৎ করেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, তিনি নিজ হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এলেন আমার জন্য! — "নাও, চা খাও!"
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। একজন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নিজ হাতে আমাকে চা বানিয়ে দিচ্ছেন! এ কি সত্যি? নাকি কোনো গল্পের ভেতর ঢুকে পড়েছি আমি? তার সহধর্মিণীও ছিলেন পাশে, তিনিও একজন বড়মাপের লেখক। তার ব্যবহারেও পেলাম সেই একই মাধুর্য, বিনয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা দুজনই যেন আলোর দুটি প্রতিমূর্তি, যাদের স্পর্শ পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছিলাম। এক ঘণ্টার এক অনন্ত স্মৃতি আমাদের কথোপকথন চলল প্রায় এক ঘণ্টা। অথচ মনে হলো যেন এক নিমেষে কেটে গেল সময়টা। তিনি কথা বললেন তার শৈশব নিয়ে, তার লেখালেখির শুরুর গল্প, তার সাহিত্যকর্মের অনুপ্রেরণা। আমি ভাবছিলাম, এত বড় একজন লেখক, যার সাহিত্যিক ক্ষমতার স্বীকৃতি নোবেল পুরস্কারে মুদ্রিত হয়েছে, তিনি এত সহজ, এত সরল কীভাবে? তিনি হাসলেন, — "সাহিত্য তো মানুষের কথা বলে, তাই না? যদি মানুষকে বুঝতে না পারো, তবে কীভাবে সাহিত্য সৃষ্টি করবে?" সেদিন আমি বুঝলাম, সত্যিকারের সাহিত্যিকের পরিচয় লুকিয়ে থাকে তার বিনয়, সারল্য আর গভীর মানবিকতায়। শেষ বিদায়, কিন্তু অমলিন স্মৃতি যখন উঠে দাঁড়ালাম, তখন মনে হলো, এই সময়টা যেন থমকে থাকুক। কিন্তু বাস্তবতা তো আর থেমে থাকে না! তিনি বিদায়ের আগে বললেন, — "বাংলাদেশে কখনো আসিনি, তবে আশা করি একদিন আসব। তোমার দেশকে শ্রদ্ধা জানাই, তোমাদের সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা রইল।" আমি সেদিন শুধু এক নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের সাথে সাক্ষাৎ করিনি, আমি জেনেছি এক মহৎ হৃদয়ের মানুষকে। তার আন্তরিকতা, তার স্নেহ, তার বিশাল হৃদয়—এসবই আজও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। একটি সোনালি অধ্যায় সময় চলে যায়, কিন্তু কিছু মুহূর্ত চিরন্তন হয়ে থাকে। সে সন্ধ্যার চায়ের কাপের ধোঁয়া আজও আমার মনে ভাসে, তার সেই মৃদু হাসির ছবি আজও আমার চোখে লেগে আছে। আমি হয়তো কখনোই জানতে পারব না, কীভাবে সেই সাক্ষাৎ আমার ভাগ্যে জুটেছিল। কিন্তু আমি জানি, সেই মুহূর্তটিই আমার সাহিত্যজীবনের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। সত্যিই, কিছু স্মৃতি কখনো পুরোনো হয় না, কিছু অভিজ্ঞতা কখনো মুছে যায় না। লে ক্লেজিওর সাথে সেই এক ঘণ্টার আলাপ আমার জীবনের এক সেরা সাহিত্যিক উপহার হয়ে রইল, যা আমি কখনোই ভুলতে পারব না! জে. ম্যারি গুস্তাভ লে ক্লেজিও: সাহিত্যিকের স্বপ্ন, প্রেম ও সাধনার গল্প- ফরাসি সাহিত্যের বিস্তীর্ণ ভূবনে অনেক প্রতিভাধর লেখকের পদচারণা ঘটেছে, যারা তাঁদের সৃজনশীল চিন্তা ও গভীর জীবনদর্শনের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে অমূল্য অবদান রেখেছেন। এই ধারায় একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন জে. ম্যারি গুস্তাভ লে ক্লেজিও। ২০০৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, এবং তাঁর সাহিত্য জীবন নিয়ে আলোচনা করলে বোঝা যায়, তিনি সাহিত্যকে কেবল পেশা নয়, বরং জীবনের ধ্রুবতারার মতো দেখেছেন। একবার এক সাহিত্যপ্রেমী যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “একজন বড় লেখক হতে হলে কী কী অনুসরণ করতে হয়?” তিনি গভীর গুরুত্ব সহকারে উত্তর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, “একজন লেখকের প্রকৃত সফলতা তখনই আসে, যখন তিনি নিজেকে বইয়ের জগতে বিলীন করে দিতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে প্রেমই হচ্ছে লেখকের প্রকৃত প্রেম, কারণ এ প্রেমের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। পাঠাগারই হচ্ছে সেই প্রেমের পরিপূর্ণ ক্ষেত্র।” সাহিত্য ও নোবেলজয়ী লেখকদের প্রতি শ্রদ্ধা লে ক্লেজিও সবসময়ই ফরাসি সাহিত্যের সুবর্ণ ইতিহাস ও নোবেলজয়ী লেখকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেছেন। তিনি ভিক্টর হুগো, আলবেয়ার কামু, জঁ-পল সার্ত্র, মার্সেল প্রুস্তের মতো দিকপাল সাহিত্যিকদের নাম উল্লেখ করে বলেছেন, তাঁদের সাহিত্য শুধু সময়কে ধারণ করে না, বরং সময়ের সীমানা অতিক্রম করে নতুন নতুন ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। বিশেষত আলবেয়ার কামু ও জঁ-পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শন তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি মনে করতেন, সাহিত্য কেবল গল্প বলার মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি দার্শনিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্র। আলোচিত ও সমালোচিত লেখাগুলো লে ক্লেজিওর সাহিত্য জীবনে বেশ কিছু গ্রন্থ রয়েছে, যা আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস "Le Procès-Verbal" (1963) তাঁকে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত করে এবং এটি রেঁনোদো পুরস্কার লাভ করে। তবে তাঁর নোবেল পুরস্কারের অন্যতম কারণ ছিল তাঁর সাহিত্যকর্মের মানবিক গভীরতা ও সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে— "Désert" (1980): যেখানে তিনি উত্তর আফ্রিকার সাহারায় বসবাসরত এক যাযাবর জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম ও প্রাচীন সংস্কৃতির কথা তুলে ধরেছেন। "L’Africain" (2004): এটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, যেখানে তিনি তাঁর শৈশব ও আফ্রিকার স্মৃতি বর্ণনা করেছেন। "Ourania" (2006): এটি একটি দার্শনিক ও কল্পনাধর্মী উপন্যাস, যেখানে ইউটোপিয়ান সমাজের সন্ধান রয়েছে। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে ভবঘুরে জীবন, উপনিবেশবাদের প্রভাব, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, এবং মানবিক অস্তিত্বের গভীর প্রশ্ন। প্রেম, লাইব্রেরি ও লেখকের জীবন যখন তাঁকে প্রেমের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, তিনি মুচকি হেসে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি আরও বলেন, "একজন লেখকের প্রেম আসলে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং বইয়ের পাতায় পাতায় সে ছড়িয়ে থাকে।" তিনি ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলেন, “আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রেম করেছি লাইব্রেরিতে, ‘বউ’ নয়, বরং ‘বই’ নামের প্রেমিকাদের সঙ্গে।” এই কথার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, একজন প্রকৃত লেখক তাঁর সময়ের সিংহভাগই ব্যয় করেন বই পড়ায় ও লেখায়। পাঠাগারই তাঁর সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা, কারণ সেখানেই তিনি নিজের চিন্তার গভীরে ডুব দেন। একজন লেখকের সার্থকতা লে ক্লেজিও মনে করতেন, একজন লেখকের প্রকৃত সার্থকতা তখনই আসে, যখন তিনি পাঠকের মনের গহীনে প্রবেশ করতে পারেন, তাঁদের ভাবনার খোরাক দিতে পারেন। লেখালেখি শুধু কল্পনার খেলা নয়, বরং এটি একটি দায়বদ্ধতা, একটি দায়ভার। একজন লেখক ইতিহাসের, সংস্কৃতির, সমাজের এবং মানবতার এক অনিবার্য সাক্ষী। তিনি বারবার বলেছেন, “একজন লেখকের জীবনের সোনালি সময় কাটে লাইব্রেরিতে, কারণ সেখানে সে জ্ঞান আহরণ করে, চিন্তার গভীরে প্রবেশ করে, এবং নিজের অস্তিত্বের সবচেয়ে সুন্দর রূপটি খুঁজে পায়।” লে ক্লেজিওর সাহিত্যজীবন আমাদের শেখায়, লেখালেখি কোনো অলীক স্বপ্ন নয়, এটি এক ধৈর্য, নিষ্ঠা, ও গভীর প্রেমের বিষয়। তাঁর জীবন ও সাহিত্য থেকে আমরা বুঝতে পারি, একজন প্রকৃত লেখক বইয়ের পাতায় হারিয়ে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পান, এবং সেখানেই তিনি চিরন্তন হয়ে থাকেন। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক জিন-ম্যারি গুসতাভ লে ক্লেযিও: এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সাহিত্য শুধু সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি এক ধরনের প্রতিবাদ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়। এমনই এক নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক জিন-ম্যারি গুসতাভ লে ক্লেযিও, যিনি তাঁর লেখনীতে তুলে এনেছেন মানুষের অন্তর্দহন, সমাজের বঞ্চনা এবং সভ্যতার সংকট। জন্ম ও শিক্ষা ১৯৪০ সালের ১৩ এপ্রিল ফ্রান্সের নিস শহরে জন্মগ্রহণ করা লে ক্লেযিওর পূর্বপুরুষেরা ফরাসি উপনিবেশ মরিশাসের বংশোদ্ভূত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার নাইজেরিয়ায় পাড়ি জমায়, যেখানে তাঁর পিতা একজন চিকিৎসক ছিলেন। এই সময় থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন এবং ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। সাহিত্যিক জীবন ও প্রধান রচনা লে ক্লেযিওর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস Le procès-verbal (The Interrogation) দিয়ে, যা তৎক্ষণাৎ সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর একের পর এক তিনি লিখে গেছেন La fièvre (1965), Le déluge (1966), Terra Amata (1967), La guerre (1970) এবং Désert (1980)। তাঁর Désert উপন্যাসটি বিশেষভাবে আলোচিত হয় এবং তিনি ফ্রান্স একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। এই গ্রন্থে তিনি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা কীভাবে উত্তর আমেরিকার মরুভূমির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেছে, তা তুলে ধরেন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি শিশু-কিশোরদের জন্যও সাহিত্য রচনা করেন, যার মধ্যে Lullaby (1980) এবং Balaabilou (1985) উল্লেখযোগ্য। তাঁর অনেক রচনা মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার আদিবাসী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, যা তিনি তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আয়ত্ত করেছিলেন। নোবেল পুরস্কার ও সাহিত্যদর্শন ২০০৮ সালে লে ক্লেযিও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে "একজন নতুন দিগন্তের পথিক, কাব্যিক অভিযাত্রী এবং সংবেদনশীল আনন্দের অন্বেষণকারী, যিনি প্রচলিত সভ্যতার বাইরে ও নিচে থাকা মানুষের প্রতি গভীর মানবিকতা দেখিয়েছেন" বলে স্বীকৃতি দেয়। তাঁর সাহিত্য মূলত আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতা, উদ্বাস্তু জীবনের সংগ্রাম এবং পরিবেশগত সংকটকে কেন্দ্র করে গঠিত। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে উপনিবেশবাদ, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো। লে ক্লেযিওর সাথে এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ ৭৮তম পেন ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেসে উপস্থিত হয়ে লে ক্লেযিওর বক্তব্য শোনার এবং তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার বিরল সুযোগ হয়। এই কংগ্রেসে তিনি তুলে ধরেন বিশ্বজুড়ে লেখক ও সাংবাদিকদের ওপর চলমান নির্যাতন ও নিপীড়নের বাস্তব চিত্র। তিনি বলেন, "সত্যের পক্ষে কলম ধরতে গেলে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু তবুও একজন লেখককে সত্যের পথেই থাকতে হবে।" ব্যক্তিগত আলাপে লে ক্লেযিও বলেন, লেখালেখি হলো একধরনের সাধনা। এটি শুধুমাত্র শখ বা পেশা নয়, বরং এটি একটি আত্মিক অনুশীলন, যেখানে ধৈর্য, অধ্যবসায় ও গভীর চিন্তা অপরিহার্য। তিনি আবারও পুনরায় বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে লে ক্লেযিওর মতামত বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "বাংলাদেশ হাজার বছরের সাহিত্য-ঐতিহ্যের ধারক। বিশেষত মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বিশ্ব দরবারে অনন্য স্থান অধিকার করে আছে।" তিনি আরও উল্লেখ করেন, "বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু পর্যটনের জন্য নয়, সাহিত্যচর্চার জন্যও অনুকূল পরিবেশ প্রদান করে। প্রকৃতি সবসময় সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণা জোগায়।" জিন-ম্যারি গুসতাভ লে ক্লেযিও শুধুমাত্র একজন নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক নন, বরং তিনি বিশ্বসাহিত্যের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় মানবতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পরিবেশের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে সময় কাটিয়ে এবং তাঁর চিন্তাধারার কাছাকাছি গিয়ে আমি উপলব্ধি করেছি, প্রকৃত লেখক হতে হলে শুধু শব্দের কারিগর হলেই চলে না, বরং একজন লেখকের মানবিক ও নৈতিক অবস্থানও সুদৃঢ় হতে হয়। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে লে ক্লেযিওর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ তিনি কেবল গল্পকার নন, বরং তিনি মানবতার গল্প বলেন—প্রতিবাদের ভাষায়, ভালোবাসার ভাষায়। চলবে--
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com