অন্জনা রহমান, বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি শুধুমাত্র একজন অভিনেত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী হিসেবেও বাংলা সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব রেখেছেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর অবদান, প্রতিভা এবং ব্যক্তিত্ব চিরকাল অমলিন থাকবে। গত নভেম্বর ৩০ তারিখে গ্রীণলীফ ম্যাগাজিনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে, যেখানে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব একত্রিত হয়েছিলেন, অন্জনা রহমান তার নৃত্যশিল্পী হিসেবে সম্মাননা গ্রহণ করেছিলেন। তখনও কেউ জানতেন না, এটি হবে তাঁর জীবনের শেষ অনুষ্ঠান। অন্জনার জীবনের প্রথম পদচারণা- অন্জনা রহমান বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন চিরকালীন ব্যক্তিত্ব। তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল একেবারে নতুন এবং সজীব ভাবে, যেখানে তিনি শুধুমাত্র অভিনয়ই করেননি, তার নৃত্যশৈলীও ছিল মুগ্ধকর। তিনি ৮০ দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান অভিনেত্রী ছিলেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র "দূস্যুবনহুর" ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের মাইলফলক। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো দর্শকদের সামনে আসেন এবং তৎকালীন সময়ের দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাঁর অভিনয়ের গুণাবলি এবং নৃত্যের দক্ষতা তাঁকে অতি দ্রুত তারকার খ্যাতি এনে দেয়। প্রথম ছবিতে নায়িকা হিসেবে তাঁর উপস্থিতি ছিল আভিজ্ঞানপূর্ণ। ছবির দৃশ্যগুলোতে যেমন তিনি আবেগের গভীরতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তেমনি তাঁর নাচের কৌশলও ছিল অসাধারণ। "দূস্যুবনহুর"-এ তার নাচের ভঙ্গি, চোখের চাহনি, হাসিমুখে কথা বলা—সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা। এই ছবি তাঁকে শুধু জনপ্রিয়তা এনে দেয়নি, বরং তাকে বাংলা সিনেমার এক নতুন তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
নৃত্যশিল্পী হিসেবে অন্জনা-
অন্জনা রহমান শুধুমাত্র একজন অভিনেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক অনবদ্য নৃত্যশিল্পী। তার নাচের ভঙ্গি, কোমলতা এবং নিপুণতা বাংলা সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। চলচ্চিত্রে তার নৃত্যসংগীতগুলো ছিল দর্শকদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন ধরণের নৃত্যশিল্পে দক্ষতা থাকায় অন্জনা খুব দ্রুত তার প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তবে, তার নৃত্য ছিল একেবারেই শুদ্ধ এবং আবেগপূর্ণ, যা দর্শকদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলত। তাঁর নাচের একাগ্রতা ও পেশাদারিত্ব ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নৃত্যে তিনি ছিলেন এক ধরনের মসৃণতা, যা অভিনয় এবং নৃত্যকে একত্রিত করে সোনালী মুহূর্ত তৈরি করত। তাঁর নৃত্যশৈলী প্রতিটি দৃশ্যে ছিল একটি বিশেষ আবেদন। তার অনবদ্য নৃত্য দক্ষতার কারণে বাংলা চলচ্চিত্রের নৃত্যশিল্পে তিনি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছিলেন।
ব্যক্তিত্বের আলোকচ্ছটা-
অন্জনা রহমান শুধুমাত্র তার প্রতিভার জন্যই নয়, বরং তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে সর্বত্র প্রশংসিত ছিলেন। তিনি ছিলেন এক ভদ্র, সজ্জন, হাস্যোজ্জ্বল এবং বিনয়ী মানুষ। সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর আচরণ ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আন্তরিক। কোনো কিছুর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল, বিশেষ করে সংস্কৃতির প্রতি, যা তার কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পেত।
অন্জনার ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। তাঁর মধ্যে এমন এক ধরনের মহত্ব ছিল যা সহজেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। দর্শকদের কাছে তিনি ছিলেন একজন মহীয়সী, যারা তার অভিনয় ও নৃত্য দেখে মুগ্ধ হতেন, আবার তার মানবিকতা ও আচার-ব্যবহারেও অনুপ্রাণিত হতেন।
সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর উপস্থিতি- ২০২৪ সালের নভেম্বর ৩০ তারিখে, গ্রীণলীফ ম্যাগাজিন কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে সোনারগাঁও হোটেলে তাঁকে সম্মাননা জানানো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিভিন্ন পেশার খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা। অনুষ্ঠানে একটি বিশেষ আড়ম্বর ছিল, এবং উপস্থিত সবাই খুবই গর্বিত ছিলেন, বিশেষত যারা অন্জনার কাজকে
এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেই শ্রোতা-দর্শকরা।
এই অনুষ্ঠানে আমি নিজে, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের মহাসচিব হিসেবে, সম্মাননা লাভ করেছিলাম। সেই সময়, তসলিম হাছান হুদয় এর আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন গুণী মানুষ একত্রিত হতে পেরেছিলেন। অনুষ্ঠানে যাদু শিল্পী জুয়েল আইচ, ব্যারিস্টার মীর হেলাল, এবং আরো অনেক বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত ছিলেন। সেদিন, অন্জনার বক্তব্য ছিল খুবই আন্তরিক এবং প্রেরণাদায়ক। হাস্যোজ্জ্বল মুখে তিনি তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতির প্রতি তার ভালোবাসা তুলে ধরেন। এই মুহূর্তগুলো আজও আমার স্মৃতিতে জীবন্ত, কারণ ওইদিনই কেউ জানত
না, সেটিই হবে তার জীবনের শেষ অনুষ্ঠান।
অন্জনার চিরবিদায়-
হঠাৎ করেই আমাদের প্রিয় অন্জনা রহমান চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। তার প্রয়াণ সংবাদটি আমাদের সকলকে স্তম্ভিত করে দেয়। একজন শিল্পী, যে তার জীবনের অনেকটা সময় দিয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র এবং সংস্কৃতির বিকাশে, তাকে হারানো এক কঠিন আঘাত। তার উপস্থিতি, তার কথা বলার ধরন, তার হাসি—সবকিছুই আজ আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে।
অন্জনা রহমান শুধু এক কালে পর্দায় রোমান্টিক বা নাটকীয় চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি, যিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে অন্যদের
অনুপ্রাণিত করতেন। তার চরিত্রের অমলিনতা এবং মানবিক গুণাবলি তার অভিনয় এবং নৃত্যে এক আশ্চর্য সমন্বয় সৃষ্টি করেছিল।
তাঁর স্মৃতি ও অবদান-
অন্জনার স্মৃতি চিরকাল আমাদের সঙ্গে থাকবে। তাঁর অভিনয়, নৃত্য, এবং বিশেষত তাঁর সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক অমূল্য অবদান হয়ে থাকবে। এই শিল্পী, যিনি একসময় আমাদের সামনে উজ্জ্বল ছিলেন, তাঁর অকাল প্রয়াণ আমাদের একটি বড় শূন্যতা ছেড়ে গেছে। তবে, তার অবদান সব সময় জীবিত থাকবে।
তিনি কেবল মাত্র একজন অভিনেত্রী বা নৃত্যশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংস্কৃতির এক অমূল্য রত্ন, যার স্মৃতি বাংলার চলচ্চিত্র ইতিহাসে অক্ষয় থাকবে। অন্জনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, আমি আজকের লেখাটি শেষ করছি, জানিয়ে যে, তাঁর অনবদ্য অবদান এবং প্রভাব আজীবন আমাদের মনে থাকবে। আমাদের জন্য এই শিল্পী শুধু একজন নায়িকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক যুগের প্রতিনিধি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com