বাটালি হিলের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন সকালটা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়, তখন মনে হয় যেন চট্টগ্রামের বুকে এক নীরব পাহারাদার জেগে আছে। বাতাসে ভাসমান শব্দেরা পাহাড়ের গায়ে গা ঘেঁষে বয়ে যায়। এখানে দাঁড়ালে মনে হয় – পাহাড় শুধু দেখেই না, শুনেও ফেলে।
আজকের সকালটা একটু ভিন্ন ছিল। শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন চাইল হাঁটতে। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস বলে কথা! তাই শতায়ু অঙ্গনের দিকে পা বাড়ালাম। পাহাড়ের উঁচুতে ওঠার পর শরীরটা একটু হালকা লাগল। পরিচিত মুখেরা হেসে শুভ সকাল জানালেন।
দুইজন পুরনো বন্ধু, দু’জনেই শিক্ষাবিদ, নাম দুটোও এক – জসিম। তাঁরা আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন,
— "কামাল ভাই, আজ একটা মজার লেখা লিখবেন। পাহাড়ের কান নিয়েই লেখেন!"
আমি হেসে বললাম,
— "পাহাড়ের কান! পাহাড়েরও কান থাকতে পারে? দেওয়ালের কান শোনা ছিল, আজ দেখি পাহাড়ও শোনে!"
কথা গড়িয়ে যায়, হাস্যরস জমে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, কথাটা খুব সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পাহাড়ের গায়ে যে বাতাস লাগে, সে বাতাসই তো আমাদের কথা অন্য কোথাও নিয়ে যায়। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলোগুলো যেন চোখে চোখে রাখে চট্টগ্রাম শহরকে।
ডিআইজি বাংলো, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাসা, গণপূর্ত বিভাগের বড় কর্মকর্তাদের বাংলো – সবই পাহাড়ের কাঁধে গাঁথা। তাদের জানালার ফাঁক দিয়ে হয়তো আমাদের কথার প্রতিধ্বনি ফিরে আসে। আগে বলা হতো "দেওয়ালেরও কান আছে", এখন সেই দেয়াল যেন পাহাড়ের রূপ নিয়েছে। কেউ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বললে, সেই কথা হয়তো নিচে কেউ শুনছে। পাহাড়ের নিচেই তো আছে অসংখ্য কান – মানুষ, বাড়ি, জানালা আর বাতাস।
গোপন কথা কি আর গোপন থাকে? বাতাস যে কথা বহন করে, তা পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকে, তারপর কারো না কারো কানে গিয়ে পৌঁছায়। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মনে হলো – সত্যিই, আমরা যাদের উপর ভরসা করি, যাদের সামনে গোপন কথা বলি, তাদের মধ্যেই কেউ কেউ পাহাড়ের কান হয়ে যায়। সেই কান একদিন আমাদের কথাগুলো বাতাসে ছেড়ে দেয়। পাহাড়ে বাস করা মানুষগুলোও তো বাতাস শোনে।
কল্পনার খেলা তো এমনই – পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, পাহাড় শুধু ভূমি নয়, সে এক জীবন্ত সত্তা। পাহাড়ের কানে বাতাস কথা বলে, ঝরা পাতারা ফিসফিসিয়ে কিছু জানিয়ে যায়। ভোরের আলোয় যখন আমরা সেখানে হাঁটি, তখন পাহাড়ের কান জেগে ওঠে।
আমরা যখন বন্ধুদের সঙ্গে হাসতে হাসতে কথার ফাঁকে কোনো সত্য বা গোপন কথা বলে ফেলি, তখন হয়তো পাহাড়ের কানে তা পৌঁছায়। তারপর সেই কান হয়ে যায় আমাদের আশেপাশের কেউ, যারা সেই কথাটা পাহাড়ের গা বেয়ে শহরের নিচে ছড়িয়ে দেয়।
বাটালি হিলের সবুজ পথের মাঝে হেঁটে এই কথাগুলো মনে হতে থাকে। চারপাশে নীরবতা, কিন্তু নীরবতাও কি এক ধরনের কান নয়? আমরা বলি, পাহাড়ের কান নেই, কিন্তু তার আত্মা আছে।
পাহাড়ের প্রতিটা পাথর, প্রতিটা বৃক্ষ আর প্রতিটা পাখি যেন একেকটা কান হয়ে আমাদের প্রতিদিনের গল্প শুনে যায়। সেই গল্প হয়তো পাহাড় তার গভীরে লুকিয়ে রাখে, আবার কোনো একদিন বাতাস হয়ে শহরের অন্য প্রান্তে নিয়ে যায়। তাই, সাবধান হওয়া ভালো। পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে বলার মতো কথাগুলো যেন বাতাসের পাখায় ভর করে দূরে না চলে যায়। কারণ পাহাড়ের কান যে সবসময়ই খোলা থাকে!
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com