চট্টগ্রামের রাস্তায় যখন সকালে শহর ধীরে ধীরে জেগে ওঠে, তখন এক কোণায় নীরবে অপেক্ষা করেন ইদ্রিস। ক্লান্ত শরীর আর চোখে জমে থাকা গভীর দুঃখের ছাপ স্পষ্ট। হাতে রিকশার হ্যান্ডেল, মনে জীবনসংগ্রামের ভার। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে তার চাওয়া-পাওয়ার হিসেব শূন্য।
এই গল্প শুধু ইদ্রিসের নয়, এটা আমাদের সমাজের হাজারো বাবা-মায়ের গল্প। এক বাবার স্বপ্ন, আত্মত্যাগ আর বুকফাটা কষ্টের নিঃশব্দ আর্তনাদ। ইদ্রিসের অতীত: ইদ্রিস কর্ণফুলীর ওপারে তরকারির দোকান চালাতেন। সকালবেলায় বাজার থেকে টাটকা সবজি এনে ব্রীজঘাটে বিক্রি করতেন। ছোট সংসার, স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে তার পৃথিবীটা ছিল ছোট্ট কিন্তু আনন্দে ভরা। তার স্বপ্ন ছিল ছেলেরা বড় হয়ে মানুষ হবে, চাকরি করে সংসার চালাবে। ছেলেদের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন। ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করা, বই-খাতা কেনা, কোচিং ফি দেওয়া—সবই করেছেন হাসিমুখে। ছেলেদের সাফল্য: ইদ্রিসের স্বপ্ন একদিন সত্যি হয়। তার দুই ছেলে ডায়মন্ড সিমেন্ট কোম্পানিতে ভালো চাকরি পায়। ছেলেরা নিজেদের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বড় ছেলের বিয়ে হয় প্রথমে, এরপর ছোট ছেলেও সংসার শুরু করে। ইদ্রিস ভাবলেন, এতদিনের কষ্টের দিন শেষ হলো। এবার ছেলেরা সংসারের হাল ধরবে, তিনি আর তার স্ত্রী একটু শান্তিতে থাকবেন। প্রথম আঘাত: সেই স্বপ্ন খুব বেশি দিন টিকলো না। একদিন ইদ্রিস অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসার জন্য ছেলেদের ফোন দিলেন। বড় ছেলে বলল, “বাবা, অফিসে খুব কাজ, পরে দেখছি।” ছোট ছেলেও একই কথা বলল।
সেদিন ইদ্রিস নিজে হাসপাতালে গেলেন, পাশে শুধু তার স্ত্রী। সেদিনই প্রথমবার ইদ্রিসের মনে হলো—শত চেষ্টার পরও তারা একা বড় ছেলের বাড়িতে যাওয়া: গত ঈদে ইদ্রিস আর তার স্ত্রী বড় ছেলের বাসায় গিয়েছিলেন। নাতির মুখ দেখার আশা নিয়ে গিয়েছিলেন তারা। দরজা খুলে ছেলের বউ দাঁড়িয়ে রইল।
"বউ বল্লো আপনর ছেলে বাসায় নেই, পরে আসেন।" "আমরা একটু বসতে পারি?" "ভেতরে কাজ আছে, পরে আসেন।" ইদ্রিস কিছু বলতে পারলেন না। স্ত্রী তার শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। ভারী পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন দুজন। সেদিন থেকে আর ছেলেদের বাসায় যান না তারা। রিকশায় ফিরে আসা: সংসার চালানোর জন্য আবার রিকশা চালানো শুরু করেন ইদ্রিস। যে হাতে একদিন সবজি তুলতেন, সেই হাত এখন রিকশার প্যাডেলে। কাজীর দেউরি থেকে চেরাগী পাহাড় পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ইদ্রিস সংসার চালান। কেউ জানে না, ইদ্রিস একসময় তার ছেলেদের জন্য কী পরিমাণ আত্মত্যাগ করেছিলেন।
ইদ্রিসের প্রশ্ন:"সন্তানদের জন্য সব করলাম। এখন তারা আমাদের চিনেও না। এটা কি ন্যায্য?"
কথাগুলো বলার সময় ইদ্রিসের চোখে পানি টলমল করছিল।
বিবেকের প্রশ্ন: ইদ্রিসের গল্প কি কেবল তার একার? আমাদের সমাজের অনেক বাবা-মায়ের গল্প কি এমন নয়? বৃদ্ধ বয়সে যখন একজন বাবা তার সন্তানদের মুখ চেয়ে থাকেন, তখন সন্তানরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ এই সন্তানেরা বড় হয়েছে বাবা-মায়ের অবিরাম শ্রম আর ভালোবাসায়।
ইদ্রিসের রিকশার চাকা যেমন ঘুরতে থাকে, তার বুকের ভেতর অভিমান তেমনি জমা হতে থাকে। সন্তানরা বড় হয়, সফল হয়, কিন্তু মা-বাবা হারিয়ে যায় অবহেলার অন্ধকারে।এই গল্প আমাদের শেখায়, বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ব কখনো ফেলে রাখা যায় না। আমরা যদি এই সত্য উপলব্ধি করতে পারি, তবে হয়তো ইদ্রিসের মতো আরও অনেক বাবা-মায়ের চোখে পানি আসবে না। "বিবেকের কাঠগড়ায় সন্তান: সমাজের ইদ্রিসদের নিরব কান্না" এই সমাজে হাজারো ইদ্রিস প্রতিদিন জন্মান, কিন্তু কেউ দেখে না তাদের। তারা কোনো খবরের শিরোনাম হয় না, তাদের কান্না দেওয়ালে আটকে থাকে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তারা অপেক্ষা করে ছেলেমেয়ের মুখ দেখার জন্য। কিন্তু সময়ের স্রোতে সন্তানেরা দূরে সরে যায়, ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের জীবন নিয়ে।
আমি নিজেও সেই সারির একজন। হয়তো আমার সন্তানদের প্রতি অভিযোগ নেই, কিন্তু এক বাবার হৃদয়ে সন্তানের অবহেলা যে ক্ষত তৈরি করে, তা অন্য কোনো ব্যথার সঙ্গে তুলনীয় নয়।সমাজের বাস্তব চিত্র:
আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে গড়ে তোলা হয় এই আশায় যে তারা মা-বাবার শেষ বয়সের ভরসা হবে। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, শিক্ষার সেই আলো অনেক সময় মা-বাবার চোখে জল ছাড়া আর কিছুই আনতে পারে না।
ইদ্রিস শুধু একজন মানুষ নন, তিনি এই সমাজের প্রতিচ্ছবি। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মা-বাবারা কিংবা রিকশার হ্যান্ডেলে হাত রাখা ইদ্রিসেরা আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। ছেলেমেয়েরা বড় অফিসার হয়, বিদেশে থাকে, বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। অথচ, মা-বাবার মলিন মুখের দিকে তাকানোর সময় হয় না তাদের।
সামাজিক মায়া-মমতার অবক্ষয়:
আজকাল, মা-বাবার দায়িত্ব যেন আর সন্তানের নয়, যেন সমাজেরও নয়। বৃদ্ধ মা-বাবাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সন্তানরা ভাবে, "আমি তো ব্যস্ত, আমি কেন সময় দেব?" কিন্তু এই সমাজ কি একবারও ভাবে, যে মা-বাবা নিজের খাবার তুলে দিয়ে সন্তানকে খাইয়েছে, সেই সন্তান আজ নিজের আরামের জন্য তাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? নিজের অভিজ্ঞতা: আমি একজন লেখক, কিন্তু আমি একজন বাবা হিসেবেও এই কষ্টের সাক্ষী। সন্তানদের জীবন সুন্দর করতে জীবনের সেরা সময় তাদের জন্য ব্যয় করেছি। কিন্তু আজ তাদের থেকে একটু সময় পাওয়াই যেন বড় চাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু, আমি লিখে যাই। ইদ্রিসদের গল্প লিখে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিই। যেন লিখতে লিখতে, এই সমাজের অন্তত একজন সন্তানের চোখে পানি আসে, অন্তত একজন মা-বাবা তার সন্তানকে ফিরে পায়।বিবেকের প্রশ্ন:এই সমাজ কি ভুলে গেছে সেই মমতার দিনগুলো? যে সন্তান একদিন বাবার আঙুল ধরে হাঁটতে শিখেছিল, আজ সে বাবার হাত ছাড়িয়ে চলতে শিখেছে। কিন্তু সেই হাত কি আবার ধরে টেনে নিয়ে যাবে বৃদ্ধ বাবাকে?
সমাজের প্রতিটি ইদ্রিস, প্রতিটি অবহেলিত মা-বাবা আজ প্রশ্ন রাখে বিবেকের আদালতে—এই পরিণতি কি ন্যায্য?
আমি জানি না, এই লেখা কারও জীবনে পরিবর্তন আনবে কিনা। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সমাজ এখনো সম্পূর্ণ পাথর হয়ে যায়নি। কারো না কারো হৃদয়ে আজও মায়া-মমতার ছোট্ট আলো জ্বলে আছে।
আমি লিখি এই বিশ্বাসে—একদিন সেই আলোয় সমস্ত ইদ্রিসেরা ফিরে পাবে তাদের হারানো সন্তানদের, আর এই সমাজ হয়ে উঠবে একটু বেশি মানবিক, একটু বেশি ভালোবাসাময়।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com