আওয়ামী লীগ আন্দোলন করতে গিয়ে দেশে ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। পরে, তাদের দাবিকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে শেখ হাসিনা এককভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য আদালতের রায়ে বাতিল করিয়ে দেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যেই আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছিলেন, সেই আদালত গত ১৭ ডিসেম্বর আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় প্রদান করেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ আনন্দ ও উল্লাসের মধ্যে রয়েছেন। আসলে, শেখ হাসিনার সরকারের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, এবং এর ফলস্বরূপ আজ সাধারণ মানুষ ভোগান্তি ও অসন্তোষের মধ্যে পড়ে আছেন। আন্দোলনকারীরা তখন নিজেদের দাবির সমর্থনে নানা কর্মসূচী পালন করলেও সেই সময় তারা যে দেশ-জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর ছিল, তা আজকার পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, যেটি ছিল জনগণের প্রত্যাশা এবং দেশের স্বার্থে সঠিক, তা গতকাল ১৭ ডিসেম্বরের রায়ের মাধ্যমে আবারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রায়ের ফলে জনগণের মধ্যে একটি নতুন আশা তৈরি হয়েছে এবং তারা মনে করছে যে, শেখ হাসিনার সরকারের আগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আজ সাধারণ মানুষ এর ফলস্বরূপ যে কষ্ট ও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, তার জন্য সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বকে দায়ী করছেন।
আমি এর আগেও একাধিক লেখা লিখেছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। আজকে যখন আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল নিয়ে কথা হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত বিএনপি সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যেহেতু অংশ নিচ্ছেন না, তখনই আমি এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল সহ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু করার জন্য, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁর আংশিক চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রয়োজন আছে কিনা, বিবেচনা করার জন্য আজকের এই লেখাটির মাধ্যমে বিস্তারিত উপস্থাপন করছি। সেই দিনের কথাতে ফিরে যাচ্ছি, কেমন ছিলো রাজপথ, কেমন ছিলো বাংলাদেশের জনগণ, কেমন ছিলো রাজনৈতিক নেতারা। হয়তো সেই আন্দোলন জোরদার করতে গিয়ে কি কি কর্মসূচী পালন করেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করার আওয়ামী লীগ সহ জামায়াত ও জাতীয় পার্টি। দেখুন একনজরে আন্দোলন!!
১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন
১৯৯৪ সালে মাগুরা জেলায় একটি উপনির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। নানা কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে আওয়ামী লীগ। আন্দোলন শুরুর নয় মাসের মধ্যেই জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। তাদের মতো পদত্যাগের রাস্তা বেছে নেয় জামায়াতে ইসলামী, এবং জাতীয় পার্টির এমপিরাও পদত্যাগ করেন।
১৯৯৫ সালের পুরো বছরজুড়ে হরতাল এবং অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন যতই এগিয়ে আসতে থাকে, বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করতে থাকেন। খালেদা জিয়া যেখানে সমাবেশ করতে যাচ্ছিলেন সেখানেই হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়া তার নির্বাচনী এলাকা ফেনীতে সমাবেশ করতে গেলে সেখানেও তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েন। সেখানে বিরোধী দলগুলো হরতালের ডাক দেয় এবং কালো পতাকা প্রদর্শন করে।
পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ফেনীতে দুটো সমাবেশ বাতিল করতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংস বিক্ষোভ হয়। রাজনৈতিক সহিংসতা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন জেলায় বিএনপি নেতাদের বাড়ি কিংবা অফিসে হামলা হয়। রাজশাহীর তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর বাড়িতে বোমা হামলা হয়।
বিরোধী দলের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক চাপ
১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনের পর তৎকালীন বিরোধী দলীয় শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহবান জানান, তারা যেন সেই সরকারকে স্বীকৃতি না দেয়। সে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে 'অবৈধ সরকার' হিসেবে বর্ণনা করেন শেখ হাসিনা। একই সাথে আওয়ামী লীগের রাস্তার কর্মসূচীও চলমান থাকে। আওয়ামী লীগ টানা ১০৮ ঘণ্টার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়।
সবচেয়ে বড় সহিংসতা হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, দোকানপাটে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেনাবাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। একই সাথে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর অফিসেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিরোধী দলের আন্দোলন থামাতে তাদের কিছু সিনিয়র নেতাকেও গ্রেফতার করা হয়।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক বিবাদের কোন মীমাংসা হয়নি। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক আলাপআলোচনাও চলছে মাঝেমধ্যে। দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেবার আলোচনাও উঠে। এমন অবস্থায় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে এবং ৭ই ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়।
এই আন্দোলন ও সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে, আওয়ামী লীগ, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে।আজ, সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূর্ণ হয়েছে আদালতের রায়ে। জনগণের এই দাবি আরেকবার প্রমাণ করেছে, যে পথটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল, তা অবশ্যই পুনরায় চালু করা উচিত। ১৭ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক রায় সাধারণ মানুষের ন্যায্যতার জয় ঘোষণা করেছে, আর সেই সঙ্গে আরও একবার প্রমাণিত হলো যে, জনগণের শক্তি ও সংগ্রামই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। এই রায়ের পর, শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে। এই ধরনের অসংগতি মূলক সিদ্ধান্ত যদি শেখ হাসিনা না নিতেন, তবে হয়তো আজ তাকে দেশত্যাগ করতে হতো না। তার এই সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে যে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে দেশব্যাপী এক ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
চট্টগ্রামে, আমরা আওয়ামী লীগের অরাজকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। 'অরাজকতা প্রতিরোধ কমিটি' নামে একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা প্রফেসার কামাল উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে সোচ্চার হয়েছিলাম। বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে আমরা একটি ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। সেই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশের জনগণ প্রতিরোধের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পথে নেমেছিল। যদিও শেখ হাসিনা আদালতের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাতিল করেন এবং এককভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেন, তবুও তার সেই সিদ্ধান্ত তার নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে স্থায়ীভাবে সুদৃঢ় করতে পারেনি। জনগণের ক্ষোভ, আন্দোলন ও তাদের ন্যায্য দাবির মুখে, শেখ হাসিনা সরকার কখনও শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি। আজকের এই ঐতিহাসিক রায় প্রমাণ করে যে, শেখ হাসিনার সরকার আর কখনো দেশের শাসক হিসেবে থাকতে পারবে না। জনগণ তার শাসনকে আর মেনে নেবে না, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে তারা যেকোনো আন্দোলনে প্রস্তুত।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com