"বিচারবহির্ভূত হত্যা গুমের ঘটনায় র্যাবের ভূমিকা:
ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় জাতি"
রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও আমাদের প্রশ্ন"
আমাদের দেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আজ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি এক দীর্ঘকাল ধরে চলমান এক নির্মম বাস্তবতা। সম্প্রতি র্যাবের মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান গুম ও হত্যার ঘটনায় জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে একটি দুঃখজনক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ক্ষমা কি গুম হওয়া প্রিয়জনদের ফিরিয়ে দেবে? বিচারহীনতার এই কালো অধ্যায় কি শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে মুছে ফেলা সম্ভব?
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা গুম কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়। এটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একাংশের দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা। এই অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার শুধু তাদের প্রিয়জনদের হারায়নি, তারা হারিয়েছে বিচার পাওয়ার আশাও। তাই শুধু ক্ষমা চাওয়া নয়, অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। ক্ষমার আড়ালে দায়মুক্তির অপচেষ্টা ক্ষমা চাওয়ার এই পদক্ষেপ যেন দায়মুক্তি অর্জনের একটি কৌশলমাত্র। আমরা কীভাবে নিশ্চিত হবো যে, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না? যারা এই নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত, তাদের নাম, পরিচয়, এবং অপরাধের স্বীকারোক্তি কোথায়? "মায়ের ডাক" এর পক্ষ থেকে দাবিগুলো তুলে ধরতে গিয়ে দেখি, এই পরিবারগুলো বছরের পর বছর ধরে শুধুমাত্র একটি উত্তর খুঁজছে—তাদের প্রিয়জনরা কোথায়? তাদের কী হয়েছিল? গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার, যারা এখনো প্রতীক্ষায় রয়েছে, তাদের এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? আমরা আজ দাবি জানাই: ১. গুম হওয়া ব্যক্তিদের বর্তমান অবস্থা প্রকাশ করুন।
২. অবিলম্বে গোপন বন্দিশিবির ধ্বংস করুন। ৩. বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করুন। ৪. একটি জাতীয় স্মারক জাদুঘর নির্মাণ করুন, যা ভবিষ্যতে এ ধরনের বর্বরতার পুনরাবৃত্তি রোধ করবে। মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন ক্ষমা চেয়ে যদি এই অপরাধ থেকে দায়মুক্তি পাওয়া যায়, তবে এটি দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর এক গভীর আঘাত হানবে। সত্য উদঘাটন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে, এটি আরও গুম ও হত্যার পথ প্রশস্ত করবে। আমরা বলছি না যে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সবাই অপরাধী। কিন্তু যেসব সদস্য এই অপরাধে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। অন্যথায়, পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে। আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে "মায়ের ডাক" যে সাহসিকতার সঙ্গে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তা একদিন ফলপ্রসূ হবে—আমরা এই বিশ্বাস রাখি। তবে, ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে বিচারবিহীনতার এই কালো অধ্যায় ঢেকে ফেলা যাবে না। অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করতে হবে। আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, বিচার না হওয়া পর্যন্ত, এই আন্দোলন থামবে না। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং সেই দায়িত্ব থেকে আমরা কখনো সরে আসবো না।
র্যাব: গুম, ক্রসফায়ার এবং বিতর্কিত প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একদিকে প্রশংসিত হয়েছে অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকার জন্য, অন্যদিকে সমালোচিত হয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য। বিশেষ করে "ক্রসফায়ার" ও "গুম"-এর মতো অভিযোগ এই সংস্থাটির প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গায় বড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে। গুম এবং ক্রসফায়ারের পরিসংখ্যান র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী: গুম: ২০০৪ থেকে ২০২3 সাল পর্যন্ত আনুমানিক ৬০০ জন ব্যক্তি গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ক্রসফায়ার: একই সময়ে ২,৫০০ জনের বেশি ব্যক্তি র্যাবের হাতে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। এসব সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করা হলেও, ভুক্তভোগী পরিবার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবিগুলি ঘৃণ্য বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে। গুম ও খুনের পদ্ধতি: আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গুম এবং ক্রসফায়ার আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নিখোঁজ করার এক পরিকল্পিত অভিযান চালানো হয়। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী: ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় ৯০ জন গুম হন, যাদের বেশিরভাগই বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
অনেক ক্ষেত্রে, র্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিনের বেলা লোকজনকে তুলে নিয়ে যায় এবং তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গুমের ঘটনাগুলি শুধুমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন নয়; এটি এক ভয়াবহ বার্তা দেয় যে, রাষ্ট্রীয় সংস্থা মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। র্যাবের কার্যকারিতা: অপরাধ দমন নাকি রাষ্ট্রীয় দমন? র্যাবের সাফল্যকে অস্বীকার করা যায় না। মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসবাদ এবং চাঁদাবাজি দমনে র্যাবের অনেক প্রশংসনীয় কাজ রয়েছে। তবে, এর পাশাপাশি প্রশ্ন থেকে যায়: ১. বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: সংস্থাটি কি সন্ত্রাস মোকাবিলার নামে বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে হত্যা করার বৈধতা রাখে?
২.গুমের অভিযোগ: র্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর তদন্ত কীভাবে পরিচালিত হয়? ৩.নাগরিকদের আস্থা: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কারণে কি সংস্থাটি গণমানুষের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠেছে? আওয়ামী লীগের গুম ও হত্যার রাজনীতি আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু বিরোধী দলকেই নয়, সাধারণ মানুষকেও আতঙ্কিত করে তুলেছে।
গণহত্যার মতো কর্মকাণ্ড: বিগত সময়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বা নিখোঁজ করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস: বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করার সংস্কৃতি গভীর রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে।
র্যাব কি আদৌ দরকার আছে?
র্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্কটি আসলে দ্বিমুখী।
১.পক্ষে যুক্তি: সন্ত্রাস এবং মাদক দমনে র্যাবের কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়।
২.বিপক্ষে যুক্তি:
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের কারণে এটি একটি দমনমূলক সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
র্যাবের কার্যক্রম বিচারব্যবস্থাকে বাইপাস করে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
মানবাধিকার সংস্থার দাবি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বারবার র্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো তদন্তের দাবি জানিয়েছে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কারণ সংস্থাটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর পরেও, র্যাবের কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের যেকোনো বাহিনী যদি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, তবে তা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য একটি বড় হুমকি। র্যাবের সংস্কার প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইনের শাসন মেনে চলতে হবে। ভুক্তভোগীদের পরিবারকে সত্য উদঘাটনের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি। তাই নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য র্যাবের মতো সংস্থা দরকার হতে পারে, তবে তার কার্যক্রম অবশ্যই সঠিক তদারকির অধীনে হতে হবে। অন্যথায়, এই সংস্থা গণমানুষের জন্য সহায়ক নয়, বরং আতঙ্কের কারণ হয়ে থাকবে। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন: গণতন্ত্র, পুলিশি দমন, এবং যুবলীগ-ছাত্রলীগের তাণ্ডব
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দেশ ও বিদেশে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী দল দমন, এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা রয়েছে।
পুলিশি দমন এবং ক্রসফায়ার: মানবাধিকারের লঙ্ঘন
আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষত পুলিশ এবং র্যাব, বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষের উপর দমনপীড়ন চালিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
১.ক্রসফায়ারে নিহতদের সংখ্যা:
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২3 সাল পর্যন্ত পুলিশের কথিত "ক্রসফায়ারে" ৩,২০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক কর্মী, যারা পাট-২
সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
বিশেষ করে ২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে পুলিশের "ক্রসফায়ার" কার্যক্রম তীব্র আকার ধারণ করে। ২. বিনা অপরাধে আটক:
বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিনা কারণে আটক করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তত ২৫,০০০ রাজনৈতিক কর্মীকে আটক করা হয়, যা গণগ্রেপ্তার হিসেবে পরিচিত।
পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন এবং দীর্ঘমেয়াদি মামলা চালানোর মাধ্যমে তাদের হয়রানি করা হয়েছে। ৩.গণতন্ত্রের ভঙ্গুর অবস্থা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী মত দমন করা আওয়ামী লীগের শাসনকালকে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত করেছে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাস: ক্ষমতার আশ্রয়ে দমননীতি
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং যুব সংগঠন যুবলীগ ক্ষমতার আশ্রয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য বারবার সমালোচিত হয়েছে।
১.হামলা এবং হত্যা:
ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের হামলায় গত ১৫ বছরে অন্তত ৪০০ জন নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নির্বাচন কমিশন সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের আধিপত্যের কারণে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে
১২.আলোচিত ঘটনাগুলি:
নূর হোসেন তুষারের হত্যাকাণ্ড: কুমিল্লায় যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নিহত এই তরুণের ঘটনা গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যা: ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে সরকারের সমালোচনা করার কারণে ছাত্রলীগের কর্মীরা বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে।
৩.দায়মুক্তির সংস্কৃতি:
ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে বিচার হয়নি বললেই চলে।
গণতন্ত্রের মুখোশ: আওয়ামী লীগের আচরণ গণতান্ত্রিক ছিলো কি? আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার দাবি করলেও তাদের কার্যক্রম সেটির বিপরীত চিত্র তুলে ধরে।1. বিরোধী দল দমন: নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা, এবং নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালানো গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।
২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ভোট কারচুপির অভিযোগ আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২.মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাংবাদিকদের উপর দমনমূলক ব্যবস্থা গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করেছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাংবাদিকরা ক্রমাগত হুমকি ও হয়রানির মুখে রয়েছেন।
৩. মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় কার? আওয়ামী লীগ সরকারের সরাসরি নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দলীয় সংগঠনগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে।
দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে উত্তরণ জরুরি আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দলীয় সংগঠনগুলোর যে কার্যক্রম দেখা গেছে, তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। ক্রসফায়ার এবং গুমের বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ অধ্যায় চলতে থাকবে। ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষা, এবং সকল নাগরিকের জন্য আইনের সমান প্রয়োগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
আওয়ামী লীগ সরকারকে বুঝতে হবে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে, ন্যায়বিচার উপেক্ষা করে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমিয়ে যে শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়, তা কোনোদিনও স্থায়ী হতে পারে না।র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব): গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অন্ধকার ইতিহাস বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বাহিনী গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। যদিও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাস দমন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, তবে র্যাবের কার্যক্রমে ন্যায়বিচারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি লক্ষ করা গেছে। র্যাব প্রতিষ্ঠা ও এর কার্যক্রমের পটভূমি র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে।
প্রতিষ্ঠার পরপরই "সন্ত্রাস দমন" অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা ক্রসফায়ার নামে পরিচিত।
পরবর্তী সরকারগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, র্যাবকে একইভাবে ব্যবহার করেছে।গুম ও হত্যার পরিসংখ্যান
র্যাবের কার্যক্রমে কতজন নিহত হয়েছে, তা মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনগুলো থেকে স্পষ্ট:
১.২০০৪-২০০৬ (বিএনপি-জামায়াত শাসন):
এই সময়ে র্যাবের ক্রসফায়ারে প্রায় ৫০০ জন নিহত হয়।
প্রথম দিকের অভিযানের মধ্যে অন্যতম ছিল চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী দমন অভিযান। ২. ২০০৯-২০২3 (আওয়ামী লীগ শাসন):
আওয়ামী লীগের আমলে র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা বেড়েছে।২০১৩-২০১৪ সালের রাজনৈতিক সংকটের সময় বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের দমন এবং বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে র্যাব ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যমতে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে র্যাবের মাধ্যমে ২,২০০ জনেরও বেশি গুম বা হত্যা হয়েছে। কোন সরকারের সময় বেশি গুম ও হত্যা?
বিএনপি সরকারের সময় র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যার সূচনা করে, তবে আওয়ামী লীগ আমলে এটি নীতি হিসেবে কার্যকর হয়।
র্যাবের মাধ্যমে গুম ও হত্যার হার আওয়ামী লীগের শাসনামলে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তারা র্যাবের কার্যক্রমে জড়িত বেশ কিছু কর্মকর্তার নাম সামনে এসেছে, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত: ১.বেনজীর আহমেদ (ডিজি, র্যাব ২০১৫-২০১৯): র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালীন সময়ে গুম ও হত্যার বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা ঘটে।
২০১৩-১৪ সালের বিরোধী দল দমনের অভিযানে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়, যা র্যাবের কর্মকাণ্ডের বৈশ্বিক নিন্দার প্রমাণ।
২.তারিকুল ইসলাম তৌহিদ (অপরাধ দমন শাখার প্রধান, ২০১৪):নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের ঘটনায় সরাসরি তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়।আদালত এ ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ৩. চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন (ডিজি, র্যাব ২০১৯-২০২০):
তার সময়ে বিরোধী দল দমনে র্যাবকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। ২০১৯-২০ সালে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও র্যাবের ভাবমূর্তি ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং এর সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
নিষেধাজ্ঞার কারণ:
মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলো। এর মধ্যে বেনজীর আহমেদ এবং আব্দুল্লাহ আল-মামুনের নাম উল্লেখযোগ্য।এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা আরও তীব্র হয়। গুম ও হত্যার শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় গুম এবং হত্যার শিকারদের মধ্যে অধিকাংশই রাজনৈতিক কর্মী, বিরোধী দলের সমর্থক, এবং মানবাধিকার কর্মী। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী, বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
অনেক সাধারণ নাগরিকও ভুল অভিযানের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।র্যাবের প্রয়োজনীয়তা: কি করা উচিত?
১. মানবাধিকার রক্ষা:
র্যাবকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বাহিনী হিসেবে পুনর্গঠন করতে হবে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলোর স্বচ্ছ তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ২. দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ: র্যাব এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে জবাবদিহিতা আনতে হবে।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করার উপায় নিশ্চিত করা জরুরি। ৩. গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা:
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। গুম ও হত্যার শিকার পরিবারগুলোর জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।
র্যাবের কার্যক্রমে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন শুধু বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য নয়, বরং গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে রাষ্ট্র যদি নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে সেটি আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাকে না। দায়মুক্তি এবং রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধ না হলে র্যাবের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে র্যাব এবং সংশ্লিষ্ট দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জনগণের প্রত্যাশা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নিয়ে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন, সচেতন মানুষ, এবং সাধারণ জনগণের মতামত একাধিকবার স্পষ্ট হয়েছে। তাদের প্রধান অভিযোগ হলো, র্যাবের কর্মকাণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, এবং নির্যাতনের ঘটনাগুলি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ: র্যাবকে "গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য কুখ্যাত বাহিনী" হিসেবে উল্লেখ করেছে।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়ায়।
জাতিসংঘ: র্যাবের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তদন্তের দাবি তুলেছে। গুমের ঘটনাগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন ও জনগণের মতামত মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দাবি: র্যাবের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা এবং বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সকল গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত হওয়া উচিত।
সাধারণ মানুষের একটি অংশ মনে করে, সন্ত্রাস দমনে র্যাবের প্রয়োজন ছিল। তবে, বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি এবং দায়মুক্তি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। অনেক ভুক্তভোগীর পরিবার বিচার না পাওয়ায় হতাশ।অপরাধী কর্মকর্তাদের জন্য প্রস্তাবিত শাস্তি
স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার: অপরাধ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি, যেমন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড। দায়মুক্তি সংস্কৃতি বন্ধ: অপরাধীদের রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক রক্ষাকবচ থেকে মুক্ত করতে হবে। ক্ষতিপূরণ:ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ এবং তাদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। র্যাবের কার্যক্রমের পেছনে থাকা অপরাধী কর্মকর্তাদের বিচার না হলে মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারের দাবিগুলো অপূর্ণ থেকে যাবে। রাষ্ট্র যদি সন্ত্রাস দমনের নামে নিজের নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে সেটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি হারাবে। এজন্য দ্রুত বিচার, দায়মুক্তি সংস্কৃতি বন্ধ, এবং মানবাধিকার সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখকঃ যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily banner, টেলিভিশন উপস্থাপক।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com