এক শিক্ষণীয় গল্প
এক গ্রামের ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন মকসুদ সাহেব। সারা গ্রামে তাঁর সুনাম ছিল, আর্থিক অবস্থাও ছিল বেশ স্বচ্ছল। তবুও তার মনে একধরনের অতৃপ্তি লুকিয়ে ছিল। তিনি ভাবতেন, আরেকটু বেশি টাকা হলে তিনি আরো সুখী হবেন। তাঁর এই অতৃপ্তি একসময় লোভে রূপান্তরিত হয়। একদিন এক জ্ঞানী ব্যক্তি গ্রামে আসেন। তিনি প্রচার করলেন, "এ গ্রামে এক বিস্ময়কর পাহাড় আছে, যেখানে সোনা পাওয়া যায়। তবে শর্ত হলো, আপনি যত দূর হাঁটতে পারবেন ততটা পথের সোনা আপনি পেতে পারেন। তবে, সূর্য ডুবে যাওয়ার আগেই ফিরতে হবে, না হলে আপনি সবকিছু হারাবেন।"মকসুদ সাহেব এ সুযোগের কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, "আরেকটু দূর এগোলেই আরো সোনা পাব।" তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যতটা সম্ভব দূরে যাবেন।
সকালে সূর্য উঠতেই তিনি যাত্রা শুরু করলেন। সূর্য ক্রমশ ওপরে উঠছে, আর তিনিও এগিয়ে চলেছেন, পিছনে তাকাননি একবারও। তাঁর লোভ তাকে থামতে দিল না। যতটা দূর পারলেন হাঁটলেন। যখন সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করল, তখনই তাঁর মনে হলো ফেরা দরকার। তিনি ছুটতে শুরু করলেন, কিন্তু সময় ফুরিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে সূর্য ডুবে গেল, আর সেই সাথে তিনি ক্লান্তি ও দুঃখে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সোনার পাহাড় থেকে যে সম্পদ পাওয়া সম্ভব ছিল, তা তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল চিরতরে। এই গল্প থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো—লোভ মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়। মকসুদ সাহেব যদি নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে সময়মতো ফিরে আসতেন, তবে তিনি সোনা পেতে পারতেন এবং নিরাপদে গ্রামে ফিরে যেতে পারতেন। লোভ মানুষকে অতৃপ্তি আর অপূর্ণতার মধ্যে ফেলে, শান্তি ছিনিয়ে নেয় এবং শেষপর্যন্ত তাকে শূন্য হাতে ফেলে দেয়।
তাই আমাদের জীবনের প্রকৃত সুখ খুঁজতে গেলে লোভ থেকে মুক্ত হতে হবে এবং যা প্রয়োজন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখতে হবে।
লোভ মানুষের মনের গভীর এক অন্ধকারে বাস করে, একটি তৃষ্ণা যা কখনো পূর্ণ হয় না। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখতে পাই, লোভের এই অন্ধ আকর্ষণে বহু মানুষ নিঃশেষ হয়েছে, ক্ষমতা হারিয়েছে, এমনকি জীবনও হারিয়েছে। লোভ মানুষকে এমন এক প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়, যেখানে শুরুর দিকে সে নিজের ইচ্ছেমতো এগিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু পরে সেই লোভই তাকে গ্রাস করে ফেলে, কেবল ছায়ার মতো তার পেছনে ঘুরতে থাকে।
ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে রাজারা নিজেদের ক্ষমতার মোহে জনগণকে ভুলে গেছেন, তাঁদের শাসন হয়ে উঠেছে অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, এবং অমানবিক। সম্রাট নির্মম নির্দয় শাসক যেমন হয়েছিলেন—নির্মম নেপোলিয়ন কিংবা শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথের কথা ভাবুন, যিনি ক্ষমতার মোহে আসক্ত হয়ে নিজের ধ্বংস ডেকে আনেন। তেমনি হিটলার ও মুসোলিনির মতো নেতারাও ক্ষমতার লোভে জাতিকে বিভ্রান্ত করে শেষমেষ নিজেরাও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছেন, ধর্মীয়ভাবে বললে, সমস্ত ধর্মেই লোভকে পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে লোভকে শয়তানের অস্ত্র বলা হয়েছে, যা মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে। হিন্দু ধর্মেও লোভকে পাপ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে; মহাভারতে আমরা দ্রৌপদীর চিরকুমারী থাকার লোভের ফলে ঘটে যাওয়া মহাযুদ্ধের গল্প জানি। লোভ মানুষের মনকে বিকৃত করে। এই পাপের কারণে মানুষ অন্যের কষ্টে সুখ খুঁজতে শুরু করে, অন্যের অধিকার দখল করে, এমনকি প্রয়োজন হলে নির্দয়ভাবে তার জীবনও শেষ করে। কিন্তু একসময় এই লোভই তার জীবনের সমাপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতপক্ষে, যে মানুষের যতটুকু প্রয়োজন, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। এই লোভের তৃষ্ণা পূর্ণ হয় না, বরং এটা বাড়তেই থাকে এবং নিজের হাতেই নিজের সর্বনাশ ঘটায়। পৃথিবীতে টিকে থাকা, এবং জীবনে শান্তি পাওয়ার জন্য লোভ থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা—এটাই একমাত্র মুক্তির পথ।
লোভ--তিন বন্ধু জঙ্গলের মধ্যে হাঁটছিল। হঠাৎ তারা দেখলো রাস্তার পাশে একটি ব্যাগ পড়ে আছে। তারা একসাথে ব্যাগের কাছে গেল এবং দেখলো ব্যাগ ভর্তি টাকা আর টাকা। তিনজনেই ভীষণ খুশি হল। কিন্তু সমস্যা হল টাকার ভাগ নিয়ে। তাদের মধ্যে প্রথমজন বলছিলো-“ আমিই টাকার ব্যাগটি প্রথম দেখেছি, সুতরাং আমি অর্ধেক টাকা নিবো, আর বাকি টাকা তোরা দুইজন ভাগ করে নিবি”।
২য় জন বললো “আমিই প্রথম ব্যাগে টাকা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি, সুতরাং আমি অর্ধেক আর বাকি টাকা তোরা দুইজন ভাগ করে নিবি”। ৩য় জন বললো “ তোরা তো অন্য রাস্তায় যেতে৷ চেয়েছিলি,আমিই তোদের এই পথে নিয়ে এসেছি, সুতরাং টাকার অর্ধেক আমার প্রাপ্য”।
এভাবে কথা কাটাকাটি করতে করতে তিনজনই ক্লান্ত হয়ে পড়লো। একসময় তারা খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লো। তিনজনই টাকা নিয়ে বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়, তাই তারা ঠিক করলো একজন পাশের মহল্লা থেকে খাবার কিনে আনবে আর বাকি দুইজন টাকা পাহারা দিবে। খাবার পর তারা টাকা ভাগ করবে। যথারীতি ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে একবন্ধু পাশের মহল্লা থেকে খাবার আনতে গেল। আর এই সময়ে বাকি দুইবন্ধু মিলে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করলো। বন্ধুটি খাবার আনতে না আনতেই দুইবন্ধু তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো আর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করলো। এবার টাকা দুইভাগ করলেই হবে। দুইবন্ধুই খুব খুশি। কিন্তু বন্ধুর আনা খাবার খেয়ে তারা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো। সেই ঘুম আর তাদের ভাঙলনা। বন্ধুর আনা খাবারে যে বিষ ছিল! লোভ মানব চরিত্রের এক দুর্ধর্ষমীশ প্রবৃত্তি। মানুষ যখন লোভের পথে পা বাড়ায়, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সমাজের অধিকাংশ মানুষ লোভের দ্বারা কম বেশি তাড়িত হয়। লোভ মানুষকে পাশ কাজ নিয়োজিত করে। কুবৃক্ষ ঘাঁটিত করে আর এমনই মানব জীবনের পরিসম অনেক সময় দুঃখময় হয়ে উঠে, কখনও কখনও ঘটে মৃত্যু। য়সম্প্রসারিত ভাব:
নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য দুর্ধর্ষমীয় বাসনাই লোভ। আমাদের চারপাশে সর্বদা লোভের হাতছানি। অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি, প্রতিপত্তি প্রতিত্তির প্রতি মানুষের প্রবল লোভ। লোভ মানুষ পরিবারে কথা চিন্তা না করে এমন সব কাজ করে যা অহিনের চোখে দণ্ডনীয়। ফলস্বরূপ ভরণ করে নেয় জীবনের করুণ পরিণতি। লোভের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ তার মা, বাবা, ভাইবোন সকলকে অবজ্ঞা করে। স্ত্রী বাসনা পূর্ণ করার জন্য সকলকে ভুলে যেতে দ্বিধাবোধ করে না। টাকার মোহ তাকে পাগল করে তোলে। লোভ মানব জীবনের বড় শত্রু। লোভকে এমনই পাপের আম্রা বলা যেতে পারে। তিনটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে- লোভ, অহংকার এবং হিংসা। লোভ তাদের মধ্যে একটি। মানুষ আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীবন। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহও লোভীদের পছন্দ করেন না। লোভ আর স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা তাড়িত হয়ে, মানুষ ভাইকে, বন্ধুকে হত্যা করেছে। পরিসম নিজেকে আত্মনাশনের পথ নিজেই তৈরি করেছে। এ কথা সত্য যে লোভের পথে পা দিলে একদিন তার মৃত্যু হবেই। লোভ মানুষকে জন্য পথে ক্রমশ তাড়িত করে। বেশি লোভ করা ভালো না। কথায় আছে- 'অতি লোভে তাতী নষ্ট’। আর এমনই লোভী ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়। সে অন্যায় অসত্য আর পাপের পথে ধাবিত হয়ে অকালে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। পরিণাম আসে ভয়ংকর মৃত্যু।
লেখকঃ
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান ও যুগ্ন সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily banner এবং গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com