হৃদয় তরুয়া – এক গল্প যে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছে। সে এক প্রতীক, এক সোনালি স্বপ্নের ঝরা ফুল, যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র ছিল। তার স্বপ্ন ছিল দেশকে এক বৈষম্যহীন সমাজের দিকে নিয়ে যাওয়া। তার বুকের ভেতরে যে আগুন ছিল, তা কেবল নিজের জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতিটি শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। ১৮ই জুলাই, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার রাজপথে তরুয়া যখন মিছিলের সামনে ছিল, তার কণ্ঠে ছিল প্রতিশ্রুতির শক্তিশালী আওয়াজ। সে চেয়েছিল সুবিচার, সমতার সমাজ, যেখানে কারও অধিকারে কারও হস্তক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু সেদিনের সেই সকাল তাকে নিয়তি রঙে রঞ্জিত করল – গুলি চলল, তরুয়ার বুকের তাজা রক্তে ভিজল মাটি, তার প্রাণ ঝরে গেল, আর রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল লাল রক্তের হোলি। তরুয়ার মা-বাবার জন্য এ এক স্বপ্নভঙ্গের গল্প, এক বুক ভরা আশা নিয়ে যাকে পাঠানো হয়েছিল বিদ্যার্জনের জন্য, সেই সন্তান তাদের চোখের সামনেই হারিয়ে গেল। পটুয়াখালীর সেই শান্ত গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল যে তরুয়া, সে আজ এক অমর প্রতীক – সে এক যোদ্ধা, যাকে কোনো রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ ছাপিয়ে কেবলমাত্র ভালোবাসার মানুষ বলে মনে করা হয়।
তার হত্যার বিচার আজ অনিশ্চিত। মামলার কথিত বাদী আজ রাজপথে রাজনৈতিক খেলা খেলছে। তরুয়ার পরিবার যদি তার মামলার ভার নিজের হাতে না নেয়, তবে এই বিচারও হারিয়ে যেতে পারে অন্ধকারের ঘন জালে। একদিন তরুয়ার আত্মা, যে তার জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল এই সমাজের মঙ্গল চেয়ে, অভিশাপ দেবে সেই তথাকথিত সভ্য সমাজকে।
হৃদয় তরুয়ার মৃত্যুর জন্য তার পরিবার ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না, এক মা কীভাবে বুকের ভেতরে তার সন্তান হারানোর শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে। আর এই সমাজ, এই বিচারের নামে কেবল ব্যবসা করছে, আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, নকল আসামিরা ছুটছে আতঙ্কে, আর তরুয়ার আত্মা সেই খেলার মধ্যে অশ্রুত কান্নায় কাঁপছে। এই লেখাটি উপন্যাসের মতোই লিখে রাখা উচিত, যেন মানুষের মনে তরুয়ার আত্মত্যাগের গল্প চিরকাল রয়ে যায়। যেন আমরা একদিন বুঝতে পারি – এই রক্তের দামে কেনা ইতিহাসে যেন আমরা তরুয়ার মতো তাজা প্রাণকে শ্রদ্ধা জানাতে না ভুলি। হয়তো ইতিহাস একদিন শেখ হাসিনার হাতে সেই রক্তের দাগের কথা বলবে, কিন্তু ততদিনে হৃদয় তরুয়ার কাহিনি বয়ে বেড়াবে স্বাধীনতার পথে প্রতিটি সংগ্রামের স্মৃতিতে।
নিঃসন্দেহে, হৃদয় তরুয়ার জীবনের এই অধ্যায়ের মধ্যে আরো গভীর আবেগ ও সংগ্রামের গল্প রয়েছে, যা তার আত্মত্যাগকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলে ধরবে। হৃদয় তরুয়া ছিল এমন এক সাহসী সন্তান, যে শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের মঙ্গলের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিল। সেদিনের সেই ভয়াল সকালে, রাজপথে তার নেতৃত্ব কেবল একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতীক ছিল না; বরং তা ছিল বৈষম্যহীন সমাজের জন্য এক চিরন্তন প্রতিবাদ। তার চোখে ছিল আলোর স্বপ্ন, আর মনের মধ্যে এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি। তার প্রতিটি উচ্চারণ ছিল যেন বিদ্রোহের অগ্নিশিখা, যা জ্বালিয়ে দিতে পারে অন্যায়ের সব কালো ছায়া। কিন্তু তরুয়ার পরিবারের জন্য সেই দিনটি ছিল জীবনের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে মা-বাবা ফিরে গেলেন বরিশালের সেই শান্ত গ্রামে, যেখানে হৃদয়ের প্রথম হাঁটাচলার স্মৃতি আজও তাদের মনে জ্বলজ্বল করে। সেই ঘর, যেখানে তরুয়া ছিল এক উজ্জ্বল প্রদীপ, আজ নীরবে অপেক্ষা করছে সেই শূন্যতার অনুভূতি নিয়ে। তরুয়ার মা-বাবার মনে একটাই প্রশ্ন – যে সন্তানটি এত বড় স্বপ্ন নিয়ে পথ চলেছিল, সেই কি কখনো ন্যায়বিচার পাবে না? তার বোন, তার ভাই কি আবার গর্বের সাথে বলতে পারবে যে হৃদয় তরুয়া বেঁচে আছে তাদের হৃদয়ে?
তরুয়ার হত্যার জন্য আজও সমাজে প্রশ্ন জাগছে – এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার কি আদৌ হবে? মামলাটি যেন রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আসল অপরাধীরা পেছনের পর্দায় লুকিয়ে রয়ে গেছে, আর মামলার নামে যারা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করছে, তাদের খেলা চলছে অবিরাম। এই খেলায় তরুয়ার আত্মার শান্তি তো দূরে থাক, সেই আত্মাই যেন সমাজকে প্রশ্ন করছে, "কেন আমার রক্তের দাম এতটা তুচ্ছ? কেন আমার আত্মত্যাগের মধ্যেও চলছে এমন নোংরা রাজনীতি?"
তরুয়ার আত্মত্যাগ একদিন হয়তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের স্লোগানে রূপান্তরিত হবে, কিন্তু আজ সেই নিষ্ঠুর সত্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সমাজে এখনও ন্যায়বিচার এক কঠিন স্বপ্ন। তরুয়া আমাদের শিখিয়ে গেছে, শুধুমাত্র সাহসের সাথে এগিয়ে গিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, কিন্তু তার আত্মা কি পাবে সেই শান্তি, যদি প্রকৃত অপরাধীরা না পায় তাদের প্রাপ্য শাস্তি?
এই উপন্যাসকে শেষ করতে গিয়ে একটি কথা বলতেই হয়, হৃদয় তরুয়ার রক্ত মিশে গেছে এই মাটির সাথে। আমাদের দায়িত্ব তার আত্মত্যাগকে ম্লান হতে না দেওয়া, তার স্বপ্নের সমাজ গড়ে তোলা। সেই দিনই আসবে যেদিন তরুয়ার আত্মা মুক্তি পাবে, যেদিন সমাজ তাকে ন্যায়বিচারের সম্মান দেবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com