বিবেকের অভ্যুদয়,মানুষের সন্ধানে কবির কথা -তপ্ত দুপুরের এক ঘরে, যেখানে আলোর প্রবেশ খুবই সীমিত, সেখানে একজন ব্যক্তি বসে আছেন গভীর ধ্যানে। চারপাশে নিরবতা। তার হাতে কবি মাহমুদুল হাসান নিজামীর একটি বই, তাতে লেখা কবিতার লাইনগুলো যেন কোনো গহীন বাণীর মতো তার হৃদয়ে অনুরণন তুলছে: “আমি দলদাস ধর্মদাস হতে চাই না, আমি মানুষ হতে চাই।”
তিনি আস্তে আস্তে বইটা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলেন। ভাবলেন, এই সরল লাইনগুলোর মধ্যে কত গভীরতা, কত সত্য লুকিয়ে আছে। মনে পড়লো তার নিজের জীবনের অনেক মুহূর্ত, যেখানে দল, ধর্ম বা চেতনার নামে অন্ধতার শিকার হয়েছে কত মানুষ। কতজনেরই না বিভ্রান্ত পথ চলা দেখে তার মন কেঁদেছে, কিন্তু কিছু করার সাহস হয়নি। এখনো সেই স্মৃতিগুলো যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে প্রশ্ন করছে—তোমার বিবেক কি জেগে ওঠেনি?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতেই তার জীবনের এক গল্প মনে পড়ে গেল। একদিনের দুঃসহ স্মৃতি তিনি ছিলেন এক যুবক, তখন চারপাশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল। তিনি তখন এক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এমন কিছু কাজ করেছিলেন, যা আজো তার বিবেককে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। দলের নেতারা বলেছিল—”এইটা চেতনার লড়াই, শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো চাই!” কিন্তু সেই লড়াইয়ে জয়লাভের চেয়ে হারানোর দুঃখটাই বেশি ছিল। মনে হয়েছিল, এ লড়াইয়ে তিনি মানুষত্বকেই হেরে দিয়েছেন। সেই দিন বুঝেছিলেন, চেতনার নামে যে শত্রুতা, তা আসলে কেবল এক ধরনের অন্ধত্ব। মানুষকে ‘আমরা আর ওরা’র ফাঁদে ফেলে প্রকৃত মানুষত্বকে পরাজিত করা হয়। সেই দিনের পর থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আর কখনো এমনভাবে দল বা ধর্মের অন্ধত্বে নিজেকে বিলীন করবেন না।
বিবেকের জাগরণ তিনি বুঝলেন, দলে-ধর্মে সীমাবদ্ধতা নেই, কিন্তু মানুষের অন্তরের জাগরণে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। তাই তিনি সেদিন থেকে দলের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। যখন চারপাশের মানুষ দেখলো, তিনি আর দলের আদেশের দাস নন, বরং বিবেকের পথে চলছেন, তারা প্রথমে সন্দেহ করেছিল, কিছুটা বিদ্রুপও করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা তার কাজে মানুষের সেবা আর কল্যাণের প্রমাণ দেখলো। তিনি নিজেকে ধর্মের নামে বিভক্তিতে ফেলে কখনোই কাউকে ঘৃণা করেননি। জানতেন, ধর্ম হলো মনের কল্যাণের জন্য, আর রাজনীতি হলো সমাজের কল্যাণের জন্য। আর যদি ধর্ম বা রাজনীতি কাউকে আঘাত দেয়, শোষণ করে, তবে তা ধর্ম বা রাজনীতি হতে পারে না। মানবিকতার খোঁজে একক সংগ্রাম বহু বছর পর, সমাজে যখন তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি হয়ে উঠলেন, তখনো সেই কবিতার পঙক্তিগুলো তার হৃদয়ে অনুরণন তুলতো—”আমি হিন্দু হতে চাই না, মুসলিম হতে চাই না, বোদ্ধ হতে চাই না, খ্রিস্টান হতে চাই না। আমি মানুষ হতে চাই।” তার বিশ্বাস ছিল, এই পঙক্তিগুলো শুধু কবিতা নয়, বরং তার জীবনের প্রতিজ্ঞা।
সমাজের নানা স্তরে তাকে যখনই কোনো ধর্ম বা দলের নামে বিভক্তি সৃষ্টির কাজ করবার আহ্বান জানানো হতো, তিনি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট—”আমি দলীয় রাজনীতি করি না, ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। মানুষের জন্য ভালোবাসার বন্ধনে থাকি, বিদ্বেষের লড়াইয়ে নয়।”
শ্রেষ্ঠ মানুষের সন্ধানে শেষ বয়সে এসে তিনি একটি প্রার্থনা করতে শুরু করলেন—“হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সেরা ধার্মিক বানিও না, আমাকে সেরা মানুষ বানাও, আমাকে সেরা বিবেকবান করো।”
এই প্রার্থনা তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে তুলেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকার মানুষ হওয়া মানে দানের মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করা। নিজের চাহিদাকে উপেক্ষা করে অন্যের কল্যাণে কাজ করা। যেখানে কোনো দল, ধর্ম বা জাতির সীমা তাকে বাঁধতে পারে না। তার বিশ্বাস ছিল, মানবতার উচ্চতর মাপকাঠিতে মানুষই শ্রেষ্ঠ,সবার জন্য একটি বার্তা
আজ এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি বুঝতে পারলেন, শ্রেষ্ঠ হওয়া মানে হয়তো সবার উপরে থাকা নয়, বরং সবার জন্য কিছু করে যাওয়া। তাই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি শুধু একটি কথাই বলে গেছেন, যে কথাটি তিনি মাহমুদুল হাসান নিজামীর কবিতায় খুঁজে পেয়েছিলেন— “আমি দলদাস হতে চাই না, ধর্মদাস হতে চাই না। আমি মানুষ হতে চাই।”
তিনি সবকিছু ছেড়ে, সব পরিচয়ের বন্ধন ছিন্ন করে, শুধু মানুষের জন্য বাঁচতে চেয়েছিলেন। তার জীবনের প্রতিটি কাজ ছিল মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত। তিনি চেয়েছিলেন তার জীবন হোক মানবতার মূর্ত প্রতীক, যেখানে দল, ধর্ম, জাতির ভেদাভেদ থাকবে না। তার সমস্ত প্রচেষ্টাই ছিল একটি বার্তা নিয়ে—মানুষ হও, মানুষকে ভালোবাসো। কবির প্রতিচ্ছবি: মাহমুদুল হাসান নিজামী কথিত আছে, কোনো কবি শুধু শব্দের কারিগর নন; তিনি শব্দের ভেতর দিয়ে মনের গভীরতম অনুভূতির প্রতিবিম্ব তুলে ধরেন। তেমনই এক কবি, মানবতার কবি, বিবেকের কবি—মাহমুদুল হাসান নিজামী। তার কবিতা যেন শুধু কাগজের পাতায় নয়, বরং হৃদয়ের অন্তর্গত স্তরে লেখা। প্রতিটি শব্দের পেছনে তিনি এক গভীর বার্তা রেখে যান, যা পাঠকের মনের গভীরে আলোড়ন তোলে, হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে প্রেমের জাগরণ ঘটায় এবং বিবেককে জাগ্রত করে। বিবেক ও প্রেমের মেলবন্ধন
নিজামীর কবিতা একদিক থেকে যেন আগুনের মতো, যা মনকে জাগ্রত করে। আবার অন্যদিকে তার কবিতা প্রেমের আবেশে সিক্ত—মনের মমতার প্রতিচ্ছবি, যা সকলকে এক আলোর পথ দেখায়। তিনি নিজেকে কখনোই শুধুমাত্র বাংলার কবি হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং তার কবিতা মানুষের, মানবতার। যেন তিনি প্রতিটি কবিতায় জীবনমুখী এক বার্তা বহন করেন। তার কবিতায় যেমন সমাজের অন্যায় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উঠে আসে, তেমনি সেখানে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর মানবতার প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা বিদ্যমান। মনে হয়, তিনি বলছেন—সবাই যদি দল ও ধর্মের জালে আটকা পড়ে যায়, তবে মানবতার স্থান কোথায়? তার কণ্ঠে যেন প্রতিধ্বনিত হয় সেই মানবতার অমর সুর—যেখানে বিভাজন নেই, নেই কোনো প্রাচীর।
কবির কবি: অনুবাদের অমর কারিগর মাহমুদুল হাসান নিজামীকে কবির কবি বলা হয়, এবং এটি শুধু তার প্রতিভার জন্য নয়, বরং তার অনন্য ক্ষমতার জন্যও। তার অনুবাদকর্ম শুধু ভাষান্তরের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি প্রতিটি অনুবাদে সেই কবিতার আসল সুর, আসল ভাব তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তার অনূদিত কবিতাগুলো যেন প্রাচীন কবিতাগুলোর চেয়েও বেশি সমৃদ্ধি পেয়েছে তার কলমের ছোঁয়ায়।
নিজামীর অনুবাদ কেবলমাত্র ভাষান্তরের এক কাজ নয়; এটি যেন নতুন প্রাণ সঞ্চারের এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। বিশ্বের বিখ্যাত কবিদের রচনা যখন তিনি বাংলায় নিয়ে আসেন, তখন সেই কবিতাগুলো নতুন জীবন পায়, নতুন করে পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। এতে তিনি নিজের জাতির সীমা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের দরবারে উঠে আসেন, যেন এক মহান সেতুবন্ধ রচনা করেছেন বিশ্বসাহিত্য ও বাংলার পাঠকদের মাঝে। জাতীয়তার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বমঞ্চে কবি একজন কবি কি শুধু তার ভাষা বা জাতির কবি? মাহমুদুল হাসান নিজামী প্রমাণ করেছেন, কবি একজন জাতির নয়, বরং গোটা মানবজাতির প্রতিনিধি। তার কাব্যে কখনো কোনো প্রথাগত গণ্ডি ছিল না, ছিল না সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। বরং তার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি লাইনে ফুটে ওঠে মানবতার এক নিখুঁত রূপ, যা সব সময় চিরন্তন। নিজামী এই সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ভেঙে বিশ্বসাহিত্যে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। তার কবিতা যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, যা নিরন্তর ভাবে প্রবাহিত হয়, কোনো গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে না। তিনি সেই অমর কবি, যিনি নিজের সীমানাকে ছাড়িয়ে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গেছেন। প্রেম ও প্রার্থনার একান্ত সুর নিজামীর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রেমের আধ্যাত্মিক ছোঁয়া। তার শব্দের মাঝে প্রেম, মমতা আর মানবিকতার সুর এমনভাবে মিশে থাকে, যা সহজেই পাঠককে গভীর আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তিনি যেমন মানবতার জন্য কেঁদেছেন, তেমনি মনের মমতার সুর দিয়ে কবিতার গভীরে ভালোবাসার মশাল জ্বেলে দিয়েছেন। তার কবিতা যেন সেই প্রার্থনার মতো, যেখানে মানুষ নিজেকে, নিজের বিবেককে নতুন করে খুঁজে পায়।
কবির অনন্ত সন্ধান মাহমুদুল হাসান নিজামী যেন কবিতার এক অমর স্রষ্টা, যিনি মানবতার সুর, বিবেকের সুর আর প্রেমের সুর একসঙ্গে বাজিয়েছেন। তার কবিতা কখনো ধর্মের দাসত্বে বাঁধা পড়ে না, দলীয় স্বার্থের গণ্ডিতে আটকায় না; বরং প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি লাইনে তিনি মানুষ হয়ে ওঠেন, মানুষের কবি হয়ে ওঠেন। তাই তিনি কেবল বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের এক অমূল্য সাহিত্য সম্পদ। তার মতো কবির জন্যই বলা চলে—“তুমি শুধু কবি নও, তুমি মানুষের আত্মার প্রতিধ্বনি।” মাহমুদুল হাসান নিজামী, তুমি কবিদের কবি, তুমি মানবতার এক সার্থক শব্দযোদ্ধা।
লেখকঃ চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান ও যুগ্ন সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আওয়াজ ও The Daily banner এবং গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক।