রাউজানে বিগত ২০১৭ সালের ২৯শে মার্চ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের চিত্র। অভিযোগ অনুসারে, চট্টগ্রামের রাউজানের তৎকালীন সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন পুলিশ সুপার (বর্তমানে ডিআইজি) নুরে আলম মিনা, রাউজান থানার ওসি কেফায়েত উল্লাহ, এবং নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শেখ জাভেদ। এসআই জাভেদ এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনার বিনিময়ে ফজলে করিমের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা, ১০টি বিদেশি মদের বোতল এবং এক ডজন সুন্দরী নারী উপহার পান।
এসআই জাভেদ
নুরুকে তার চট্টগ্রামের চন্দনপুরার বাসা থেকে ২৯শে মার্চ গভীর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন রাতেই নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে আটকে রেখে এসআই জাভেদ ও তার সহযোগীরা নুরুর উপর নির্মম অত্যাচার চালান। তাদের হত্যার প্রস্তুতিতে মদ্যপান করে আনন্দ-উল্লাস করেন। পরে ফজলে করিমের নির্দেশে পেশাদার কিলারদের সহযোগিতায় নুরুর মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর, এসপি নুরে আলম মিনা দুই কোটি টাকা, ওসি কেফায়েত উল্লাহ নগদ ২০ লাখ টাকা এবং এসআই শেখ জাভেদ নগদ টাকাসহ ১০টি বিদেশি মদের বোতল ও সুন্দরী নারীদের পুরস্কার পান।
নুরুর লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয় এবং পরদিন নাটকীয়ভাবে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। পরিচয় অজ্ঞাত দেখিয়ে এসআই কামালের মাধ্যমে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়, এর বিনিময়ে এসআই কামাল ৫ লাখ টাকা এবং এসপি মিনার কাছ থেকে বিশেষ প্রশংসা পান। নুরুল আলম নুরুর হত্যাকাণ্ড ছিল একটি পরিকল্পিত ও নিষ্ঠুর ঘটনা, যার মূল হোতা ছিলেন ফজলে করিম চৌধুরী, যিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডকে ঢাকতে চেষ্টা করেছিলেন।
রাতে চট্টগ্রামের চন্দনপুরার পশ্চিমগলির বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুকে। সাত বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর, অবশেষে ২০২৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী সুমি আক্তার চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় নুরুর হত্যা কাণ্ডের মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে প্রধান আসামি করা হয়েছে রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীকে। আরও ১৭ জনকে চিহ্নিত আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছেন নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির প্রাক্তন ইনচার্জ এসআই জাবেদ ও নোয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া। এছাড়াও ৩০-৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে নুরুল আলম নুরুকে সাদা রঙের মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় দুইজন পুলিশ পোশাক ধারীসহ অন্যান্য আসামিরা। তাকে চট্টগ্রামের নগরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন এবং মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন, ৩০শে মার্চ, পুলিশ তার হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কর্ণফুলী নদীর তীরে তার লাশ উদ্ধার করে। নুরুর শরীরে শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন ও মাথায় গুলির ক্ষত ছিল। মামলায় চিহ্নিত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- টাইগার নাসের, মো. লিটন, তৈয়ব, ফরিদ, মামুন, আবু জাফর রাশেদ, ইয়ার মোহাম্মদ বাছইন্না, সেকান্দর, জসিম, খালেক, বাবুল, মো. রব্বানি, হাসান মোহাম্মদ নাসির, মো. মোর্শেদ। নিহত নুরুল আলম নুরুর ঘনিষ্ঠজনরা বলেন, "নুরুকে পরিবারের সামনে থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যেখানে রাউজানের তৎকালীন এমপি ফজলে করিম চৌধুরীর নির্দেশে এসআই জাবেদের নেতৃত্বে এটি ঘটানো হয়।"
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২১শে অক্টোবর, পুলিশ হেফাজতে নুরুর হত্যার অভিযোগ এনে করা মামলার আবেদন খারিজ করে চট্টগ্রামের একটি আদালত।নুরু হত্যা কাণ্ডের পুনরায় মামলা হলেও কিন্তু সঠিক তদন্তের অনিশ্চয়তা দেখাদিয়েছে। রাউজানের নুরুল আলম নুরুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে শুরু থেকেই একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভিযোগ রয়েছে, যেখানে তৎকালীন সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, তৎকালীন এসপি (বর্তমানে ডিআইজি) নুরে আলম মিনা এবং ওসি কেফায়েত উল্লাহর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাথমিকভাবে এসআই কামাল বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন, যা তদন্তের দায়িত্বে ছিল পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর বশির। কিন্তু বশির মামলার প্রকৃত ঘটনার সত্য উদঘাটন না করেই অভিযোগ করে বসেন যে, "স্বাক্ষী পাওয়া যায়নি," এবং মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেন, যেখানে ফজলে করিমসহ অন্যান্য মূল অভিযুক্তদের নাম মুছে ফেলা হয়। আসলে, নুরুকে শহর থেকে অপহরণ করে নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসার পর, পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করা হয়। এসআই শেখ জাভেদ, ফজলে করিমের কিলার বাহিনীর সহায়তায় নুরুকে রাতে অমানবিকভাবে নির্যাতন করেন এবং মাথায় গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করেন। পরে, ওসি কেফায়েত উল্লাহ এবং এসপি নুরে আলম মিনার নির্দেশে কর্ণফুলী নদীতে তার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর বশির সঠিক তদন্ত না করে মূল আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন এবং মামলাটি একটি মিথ্যা মামলায় রূপান্তর করেন। অথচ নুরুকে হত্যার নির্দেশ ও অর্থের বিনিময়ে যারা এই জঘন্য কাজটি করেছিল, তাদেরকেই আইনের হাত থেকে বাঁচানো হয়। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, নুরুর পরিবারের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় পুনরায় একটি সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের করা হয়। তবে, এ নতুন মামলায়ও দেখা যায় যে, ডিআইজি নুরে আলম মিনাকে বাদ দিয়ে নুরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাবুলসহ আরও তিনজনকে মিথ্যা আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্তকারীরা মামলার প্রকৃত অপরাধীদের দিকে যথাযথ নজর দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।এই মুহূর্তে মামলাটি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, ফজলে করিমের অর্থ এবং ডিআইজি নুরে আলম মিনার প্রভাবের কারণে মামলাটি পুনরায় ভিন্ন পথে পরিচালিত হতে পারে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, প্রকৃত অপরাধীদের কি আদৌ বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে, নাকি এই মামলাও শেষ পর্যন্ত প্রভাবিত হয়ে অন্য একটি নাটকীয়তার পথে যাবে?নুরু হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সঠিক তদন্ত ও আইনানুগ পদক্ষেপের প্রয়োজন, যা এখনও অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।
চলবে----
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com