কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া ও বুড়িচং সীমান্তে প্রায় অর্ধ-শতাধিক মানবপাচারকারী দলের সক্রিয় সদস্য প্রতিদিন প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে মানুষ পাচার করছেন। কেউ মাদক ও চোরাকারবারির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের আশায় মানবপাচারের মত এ সব কাজ করে যাচ্ছেন।সম্প্রতি মানবপাচারের এই প্রবনতা আরো বেড়েছে। বিজিবির তৎপরতায় প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ছে পাচারকারীর দলের লোকজন ও অনুপ্রবেশকারীরা। বিজিবির সূত্রে জানাগেছে সাবেক সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী আমলা, শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত চক্রের হাত ধরে অবৈধভাবে ভারত সীমান্তের এপার ওপার আসা যাওয়া করার সুযোগ নিয়ে ধরা পরেছেন। তবে এমন পাচারকারী চক্রের সক্রিয়তাকে সীমান্ত নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় ঝুঁকি হিসেবে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যায়। এর পর থেকে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও মন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা ইউনিয়নের নেতারা গা ডাকা দেন, অনেক আবার বিভিন্ন মানবপাচারকারী মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবৈধ পথে পাড়ি জমায়। এ সুযোগে ব্রাহ্মণপাড়া ও বুড়িচং সীমান্তে সক্রিয় হয়ে ওঠে মানবপাচারকারীরা। পাচারকারীদেও মাধ্যমে ভারতের অনুপ্রবেশের জন্য পলায়নকারী এবং পাচারকারীর মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য তৈরি হয়েছে দালাল চক্র। পাচারকারীরা মানুষ প্রতি ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তি করার কথাও শোনাগেছে লোকমুখে।
জানা গেছে, মানব পাচারকারীরা বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে পর্যন্ত টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে। কাউকে মই ব্যবহার করে কাঁটাতারের বেড়ার উপর দিয়ে কিংবা বিএসএফকে ম্যানেজ করে কাঁটাতারের বেড়ার গেট খুলে এই মানব পাচার করা হয়।নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক সীমান্তের এক বাসিন্দা জানান, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা অর্থনৈতিক অসদোপায় অবলম্বন করে, আবার বিএসএফকে ম্যানেজ করে ভারতে মানুষ পাঠিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে মানব পাচারকারীরা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। শুধু যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা সাধারণ মানুষ আসা যাওয়ার চেষ্টা কওে এমন না হবার শঙ্কাও রয়েছে, কারণ অবৈধ ভাবে যদি সন্ত্রাসী কিংবা মাদক চোরাকারবারীরা সুযোগের সদব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাহলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। বুড়িচং উপজেলার একাধিক সংবাদ কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,উপজেলার খাড়েরা বিজেপি ক্যাম্পের অধীন পাহাড়পুর, শঙ্কুচাইল, আনন্দপুর, চরানল, হায়দ্রাবাদ এলাকায় দিয়ে মানবপাচার হয়। বাকশিমুল ইউনিয়নের কোদালিয়া, গদানগর, জামতলা এলাকার সীমান্ত দিয়েও মানবপাচারকারী চক্র কাজ করে। গদানগরের সুমন, কোদালিয়ার হোসেন, জামতলার রিপন ও ইমন নামে কয়েকজন মানবপাচারকারীর একটি সিন্ডিকেট কাজ করে থাকতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। ব্রাহ্মনপাড়া থেকে জানা গেছে, হরিমঙ্গল, বাঁশতলী, আশাবাড়ি, বাল্লক, নারায়ণপুর, তেতাভুমি, এলাকার সীমান্তে মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। ৫ আগস্ট এর পর থেকে এসব এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশ এর ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত তিনজন মানব পাচারকারী বিজেপির হাতে আটক হয়েছে। সূত্র বলছে, আশাবাড়ি এলাকায় খোকন, বালক এলাকায় ফারুক, কবির- সোহেল সহ বেশ কয়েকজন মানব পাচারের সাথে সক্রিয়। এছাড়া সদর উপজেলার গোলাবাড়ি, শিবের বাজার, জামবাড়ী বিভিন্ন এলাকাতেও মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয়। যারা এ সময় মাদক চলাকারবারের সাথে জড়িত ছিল তারাই এখন মৌসুমী মানব পাচারকারী হিসেবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে সীমান্তের বসবাসকারীরা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সীমান্তে এক শিক্ষক বলেন, এত গ্রেপ্তারের পরও থেমে নেই চোরাকারবারিরা। সীমান্ত অপরাধীদের জন্য এখন বসন্তকাল। গরু, মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্য পাচারের বদলে মানুষ পাচারে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে একটি চক্রটি।বিজিবির একটি সূত্র বলছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অপরাধী চক্রটি মানবপাচারে সক্রিয় হয়ে উঠছে। এ কারণে আমাদের সীমান্ত এলাকায় গোয়েন্দা তৎপরতা ও টহল জোরদার করা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে অবৈধ পথে ভারতে প্রবেশের চেষ্টাকালে ৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আওয়ামী লীগের মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম -৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি ব্রাহ্মণপাড়া থানার মাত্র এসেছি, ‘মানব পাচারের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তবে সীমান্ত এলাকা যেহেতু বিজিবির নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাই অপরাধ প্রতিরোধ করার দায়িত্বও তাদের।
সুলতানপুর ব্যাটালিয়ন ৬০ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাবের বিন জব্বার জানান, যদি মানব পাচারকারী না থাকে তাহলে যারা অনুপ্রবেশ করতে চায় তারা কিভাবে করবেন, তারাতো আর পথঘাট চেনেনা। তার মানে কেউ না কেউ তাদেরকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমে সহায়তা করছে। যারা বিভিন্ন জায়গায় মানব পাচারের সাথে জড়িত আমরা তাদেরকে ধরতে চেষ্টা করি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কুমিল্লা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোঃ রেজাউল করিম বলেন- একটি চক্র টাকার বিনিময়ে মানব পাচারে জড়িত হয়েছে। এ জন্য সীমান্তে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারসহ প্রতিরাতে পেট্রল ডিউটি আগের তুলনায় তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে।