প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলীর লেখার সূত্র ধরে আজ আমি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও এর অনিয়মের বিরুদ্ধে আমার আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই। ১৯৯৪ সালে আমি যখন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির আমি কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলাম, তখন চট্টগ্রামে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করি। তবে চট্টগ্রামে পৃথক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৮৯ সালের দিকে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ,তখন আমরা বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন গণ সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান এস এম জামাল উদ্দিন ও মহাসচিব মনোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে। সেই আনদোলনের ধারাবাহিকতায় আমি
সেই সময় চট্টগ্রামের ছাত্রদের জন্য নিজেদের শিক্ষা বোর্ডের প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণের বিষয় তুলে ধরে ৯৪ সালের ২ জুন, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে আমি তৎকালীন বিএনপি সরকারকে এই দাবি পূরণের জন্য এক মাসের আল্টিমেটাম দিই এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামে হরতালের আহ্বান জানাই। ৯ জুলাই হরতাল সফলভাবে পালিত হয় এবং আমাদের দাবীর ভিত্তিতে বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষণা দেুন এবং ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান সাহেব এর অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতে জরতে হয়।
শুধু শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠাই নয়, আমি চট্টগ্রাম থেকে ৮০ শতাংশ লোক নিয়োগের দাবিও জানাই, যা পরবর্তীতে সরকার ১০০ শতাংশ নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করে। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার পেছনে আমার আন্দোলনের অবদান আছে, এবং এই ইতিহাস লিখতে হলে আমার ভূমিকা কখনোই উপেক্ষা করা যাবে না। তবে দুঃখজনকভাবে, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতির ছায়া সেখানে বাসা বাঁধে। সম্প্রতি বোর্ডের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা, যারা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে সিন্ডিকেট পরিচালনা করছিলেন, তাকে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টে অভিযুক্ত করে ওএসডি করা হয়েছে। তার ছেলের জালিয়াতি করে প্রাপ্ত দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করা হয়েছে এবং এই কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমি বহু বছর ধরে লেখালেখি করে আসছি। প্রফেসর ইদ্রিস আলীর সাম্প্রতিক লেখায় উঠে আসা ঘটনার প্রেক্ষিতে আবারও এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলো। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন দুর্নীতি, বিশেষ করে চট্টগ্রামের মতো স্থানে, যেখানে এত আন্দোলনের মাধ্যমে একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। জনগণের স্বার্থের কথা ভেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত এই বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
দুঃখজনক হলো, এই মহামারি সৃষ্টিকারী সিন্ডিকেট এখনো বোর্ডের বিভিন্ন উচ্চপদ দখল করে রেখেছে। শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকজন সিন্ডিকেটের সুবিধাভোগী, তারা প্রতিনিয়ত পদোন্নতির জন্য মরিয়া। তারা এমন ব্যস্ত যে, তদন্ত প্রতিবেদন কার্যকর করার মতো সময়ই তাদের নেই। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একবার নির্দেশ দিয়েই চুপ হয়ে আছে, যা কেবল সাধারণ মানুষের হতাশা বাড়াচ্ছে।
শিক্ষা বোর্ডের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়মের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে বোর্ডে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে। অতএব, আমরা আশাবাদী যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বোর্ড কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। সাধারণ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য এ ধরনের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে তাদের চূড়ান্ত শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা, আর কোনো বিলম্ব ছাড়াই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্কট: ন্যায় ও স্বচ্ছতার প্রত্যাশা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান সংকট কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়, বরং আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিফলন। যখন দেশের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার সাথে যুক্ত হওয়া দুর্নীতির ঘটনা আমাদের সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে বিপর্যস্ত করে। এই দুর্নীতির ফলে শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের প্রাপ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় না, বরং তাদের ভবিষ্যত গঠনের সুযোগও হুমকির মুখে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে, আমাদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিবাদ করা জরুরি। আমাদের শিক্ষার মান, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সঠিকতা এবং স্বচ্ছতার বিষয়গুলো একসাথে জড়িয়ে আছে। সুতরাং, যখন শিক্ষার্থীরা সঠিক ফলাফল পেতে পারেন না, তখন তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এই কারণে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শিক্ষিত তরুণরা সঠিক সুযোগের অভাবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হতাশ হয়ে পড়ছে। এছাড়া, আমি মনে করি, প্রফেসর ইদ্রিস আলীর বক্তব্যে যে দাবি তোলা হয়েছে, তা সত্যিই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বোর্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত দুর্নীতি আর কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের সবার উচিত শক্ত হাতে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এবং সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। এই দুর্নীতির একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য আমাদেরকে সৎ ও ন্যায়সঙ্গত প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন, দ্রুত এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো ছাত্র বা অভিভাবককে এ ধরনের দুর্নীতির শিকার হতে না হয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া আমাদের ভবিষ্যত গড়ার আর কোনো পথ নেই।
শিক্ষার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার প্রতি জনগণের আস্থা কীভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? প্রথমত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সকল প্রতিষ্ঠানে সঠিক ও বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত পরীক্ষা এবং ফলাফল প্রকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকর করা উচিত। আমাদের তরুণদের জন্য একটি সৎ ও প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে হলে, তাদেরকে সততা, ন্যায় এবং প্রেরণার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। এটি কেবল শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করবে না, বরং আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখবে।
শিক্ষার এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে। শিক্ষকেরা, অভিভাবকরা, এবং শিক্ষার্থীরা—সবাইকে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের তরুণদের মধ্যে সঠিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেন তারা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সৎ ও উন্নত সমাজ তৈরি করতে পারে।
অতএব, শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা এবং দায়িত্বশীলতার অভাব কেবল একটি প্রতিষ্ঠানকেই নয়, বরং আমাদের সমাজের সার্বিক নৈতিক চরিত্রকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ কারণে, আমাদের এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি দৃঢ় বার্তা দেওয়া যায়।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক,
(চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সংগঠন "ছাত্র সংগ্রাম কমিটির" সভাপতি)
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com