আজ শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন। জীবনধারার মোড়ে এই বিশেষ দিনটি, যা একসময় ক্ষমতার প্রদীপে আলোকিত ছিল, আজ নিভে গেছে সময়ের সাথে। আমরা সকলেই জানি, “জন্ম হোক যথাযথ, কর্ম হোক ভালো”—এই প্রবাদটি যেন তার জীবনের প্রাথমিক অধ্যায়ে সত্য ছিল। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের শুরু ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকা ধারণ করে। তার হাতে স্বাধীনতার উত্তরাধিকার নিয়ে তিনি দেশকে এক নতুন পথে পরিচালিত করতে এসেছিলেন। কিন্তু সময়ের আবর্তে তিনি সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে একনায়কতন্ত্রের বৃত্তে বন্দী হলেন। আজ, তার দীর্ঘ শাসনের পর যখন তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তখন তার জন্মদিন আর কোনো উৎসবের রঙে রাঙানো হয়নি। শেখ হাসিনার শাসনামল দীর্ঘ হলেও তার রাজনৈতিক পথচলায় তার অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং দমননীতি দেশ ও জাতিকে গভীর সংকটে নিমজ্জিত করেছে। শুরুতে, তার শাসনামলে উন্নয়নের অঙ্গীকার থাকলেও ধীরে ধীরে এই অঙ্গীকার ম্লান হয়ে পড়ে। দেশজুড়ে দুর্নীতি, দলীয়করণ, এবং লুটপাটের কালো ছায়া বিস্তার লাভ করে। তার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ চাটুকারদের দ্বারা দেশ শোষিত হতে থাকে। যে দেশ একসময় তার নেতৃত্বের ওপর ভরসা করেছিল, সেই দেশ এখন তার নাম শুনলে বিরক্তি এবং ধিক্কার প্রকাশ করে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনোই শেখ হাসিনার রাজনীতির সমর্থক ছিলাম না, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে তাকে সম্মান জানিয়ে বহুবার তার ভালো কাজগুলো নিয়ে লিখেছি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা অটুট, এবং সেই আদর্শই আমার লেখার পথনির্দেশক। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, শেখ হাসিনার শাসনকালে আমরা শুধু তার ভালো কাজই দেখিনি, বরং তার হাতে গণতন্ত্রের মৃত্যু এবং মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের দৃশ্যও দেখেছি। একসময় যে শেখ হাসিনার জন্মদিনকে আশীর্বাদ হিসেবে মনে করা হতো, আজ সেই দিনটিকে জাতি অভিশাপ হিসেবে দেখছে।
শেখ হাসিনার শাসনকালে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল—ক্ষমতার মোহে তার অসংযত আচরণ। তার আত্মঅহঙ্কার তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে তিনি নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে করতে শুরু করেন। কিন্তু "অহংকার পতনের মূল"—এই চিরন্তন সত্যটি আজ তার জীবনের প্রতিফলনে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তার শাসন এমন একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল, যেখানে জনগণের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল, রাজনৈতিক বিরোধীদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এইভাবে তিনি গণতন্ত্রের পবিত্রতাকে অপবিত্র করেছেন।তার শাসনের সময় চাঁদাবাজি, ঘুষ, এবং লুটপাটের মাধ্যমে উন্নয়নের মোড়কে এক ভিন্ন চিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছিল। শেখ হাসিনার আশপাশে যে চাটুকাররা ছিল, তারা দেশের শাসনব্যবস্থাকে এক প্রকার নিজের সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। প্রতিটি জন্মদিনে দেশের মানুষদের ওপর চাঁদাবাজির বোঝা চাপিয়ে সেই অর্থ দিয়ে বিশাল আয়োজন করা হতো। লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যানার, ফেস্টুন, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন—এগুলো ছিল সেই চাটুকারদের প্রদর্শন। অথচ আজ, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন, আর তার জন্মদিনের আয়োজনও স্তব্ধ হয়ে গেছে। যে নেতারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতেন, আজ তারা নীরব। শেখ হাসিনার এই পতনের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তার অন্ধত্ব। তিনি তারেক রহমান, খালেদা জিয়া এবং জামাতের প্রতি এতটাই ভয় পেয়েছিলেন যে, প্রতিদিন তাদের নাম নিয়ে রাজনীতি করতেন। প্রতিটি মিটিং, প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি তাদের নিয়ে আলোচনা করতেন, যেন তাদের বিরোধিতা ছাড়া আর কোনো রাজনীতি নেই। এভাবে তিনি দেশের মূল সমস্যাগুলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। তার চাটুকারদের মুখ থেকে তিনি মিথ্যা প্রশংসা শুনে সন্তুষ্ট থাকতেন, আর সেই সময় দেশের জনগণ ছিল নিগৃহীত। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মতো একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে দেশ এবং বিশ্বজুড়ে সম্মান জানানো হচ্ছে। একসময় যিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, আজ তিনি বাংলাদেশের নতুন নায়ক হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছেন। আর শেখ হাসিনার শাসনের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত হয়ে জাতি তাকে ধিক্কার দিচ্ছে।
আজকের দিনে মনে হয়, শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে যদি কোনো আয়োজন থাকতো, তবে সেটি হয়তো চাঁদাবাজি বা দুর্নীতির অর্থেই করা হতো। এমন কোনো শাসকের জন্মদিন পালন করা যিনি নিজের দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন, তা এক ধরনের ব্যঙ্গ হিসেবেই থেকে যেত। এই জাতি যেন এমন আর কোনো নেতা না পায়, যিনি ক্ষমতার মোহে গণতন্ত্রকে হত্যা করবেন, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেবেন, এবং দেশকে দুর্নীতির জালে আটকে ফেলবেন।
শেখ হাসিনার জন্মদিন আজ আমাদের জন্য একটি কঠিন শিক্ষা: "অহংকার পতনের মূল"—এই শিক্ষাটি যেন আমরা ভুলে না যাই। আল্লাহ আমাদের জন্য তাকে একটি উদাহরণ হিসেবে সামনে এনেছেন, যার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথ বেছে নিতে পারি।আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আজও অটুট। আমাকে একসময় চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সম্মেলন আয়োজনের জন্য আহ্বায়ক করা হয়েছিল। তবে দলের ভেতরের চাটুকারদের দ্বারা আমি অপমানিত হয়েছি। আজ এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া কঠিন যে, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা এক আদর্শে বিশ্বাস করলেও, তার শাসনের পথ ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিপরীত। সেই কারণে আজ তার শাসনকালকে ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সোনালী রোদের ঝিলমিল আলো ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে আজ জাতি দ্বিধাগ্রস্ত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সত্যিকার মানুষগুলোর পুনরাগমন কবে হবে, সে প্রশ্ন দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। আমাদের সামনে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সঠিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে আরও বেশি।
আমি বিগত ৩০ বছর ধরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনে ও লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু রাজনীতির পথ আমার জন্য ছিল না। তেলবাজি, চাটুকারিতা—এগুলোতে আমি কখনোই নিজেকে মানাতে পারিনি, পারবোও না। রাজনীতির মূলধারায় না থাকলেও, কলম সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং এই পথেই আমার সংগ্রাম চলবে।
যারা আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমার কলম সবসময়ই সক্রিয় থাকবে, নির্ভীকভাবে সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই আমার নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক- সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক ও মহাসচিব-চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com